এরপরের যাত্রাপথে পোয়ারো নিজের কিছু চমকপ্রদ সাফল্যের কাহিনি শোনালেন। মি. ব্লাস্টও বাচ্চা ছেলের মতো মন দিয়ে শুনছিলেন। কখনো হো হো করে হেসে উঠছিলেন, আবার কখনো ভয়ে শিউরে উঠছিলেন।
শেষপর্যন্ত তাঁরা তাঁদের গন্তব্যে এসে পৌঁছলেন। ক্রমহ্যামের বাগান বাড়ি। সেখানে আগেই এসে উপস্থিত হয়েছিলেন জেন অলিভেরা ও তার মা মিসেস অলিভেরা।
মিসেস অলিভেরা পোয়ারোকে দেখে নিজের রাগ আর চেপে রাখতে পারলেন না। তাঁর আচরণে অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটল। তিনি পোয়ারোকে গ্রাহ্যই করলেন না। মি. ব্লাস্ট ও মি. সেলবিকে সমাদরে বাড়ির ভেতর ডেকে নিয়ে গেলেন। কয়েক মুহূর্ত আগের আনন্দমুখর পরিবেশটা নিমেষে বিষাদে পরিণত হল।
জেন এগিয়ে এসে এরকুল পোয়ারোকে নিয়ে গেলেন বাড়ির ভেতরে। দেখিয়ে দিলেন নির্দিষ্ট ঘরটিকে।
চমৎকার বাড়ি। তবে ছোট্ট। ঘরগুলো খুব সুন্দর করে সাজানো। গৃহকর্তা শৌখিন মানুষ। তাই রুচিবোধও উচ্চমানের। লণ্ডনের বাড়ি যেভাবে সাজানো ঠিক সেই ভাবেই এই ঘরগুলি সুসজ্জিত। প্রতিটি জিনিসই মহামূল্যবান। এখানকার মানুষগুলোর কাজকর্ম পরিপাটি ও পরিষ্কার। ইংরাজসুলভ খাবার এবং ইউরোপীয় বয়। উৎকৃষ্ট স্যুপ, মটরশুটি সিদ্ধ, স্ট্রবেরি ও ক্রিম দিয়ে নৈশভোজ সারলেন পোয়ারো। নৈশভোজে প্রদত্ত সুরা পোয়ারোকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছিল। তিনি আহারে এতই মগ্ন ও তৃপ্ত ছিলেন যে মিসেস অলিভেরার বিসদৃশ আচরণ ও জেনের রুক্ষ ব্যবহার মনেই রাখলেন না। আহারের শেষে এরকুল পোয়ারো ভাবলেন যে কোনো কারণেই হোক জেন তার প্রতি ক্ষুব্ধ। তাই সে বিরূপ আচরণ করছে তাঁর সাথে কিন্তু কি সেই কারণ?
মি. ব্লাস্ট মিসেস অলিভেরার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন–হেলেন আমাদের সঙ্গে খেতে বসল না কেন?
জুলিয়া অলিভেরা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলল–ওঁর বড্ড পরিশ্রম হয়েছে আজ। তাই ওকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। আমি ওকে বলেছি পোশাক পাল্টে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে।
ব্লাস্ট হতাশ হয়ে বললেন–ভেবেছিলাম সপ্তাহের শেষ দিনটি সবাই মিলে মজা করে কাটাব।
মিসেস অলিভেরা নিজের দোষ চাপা দেওয়ার জন্যে বললেন–হেলেন খুব ভালো মেয়ে। তাছাড়া ওর বেশি রাত পর্যন্ত জাগার অভ্যেস নেই।
এরকুল পোয়ারো খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লেন, তিনি ড্রয়িং রুমে এলেন, অ্যালিস্টেয়ার ও তার সেক্রেটারি সেখানে বসে রইলেন।
পোয়ারো ড্রয়িং রুমে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। তার কানে গেল জেনের রুক্ষ গলা। সে তার মাকে বলছে, মা, হেলেন মসেরকে তুমি অ্যালিস্টেয়ার কাকার চোখের আড়াল করলে কেন? তিনি খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন এতে।
মিসেস অলিভেরা কর্তৃত্বের সুরে বললেন–বেশ করেছি। অ্যালিস্টেয়ার অতি সজ্জন মানুষ। সে খুব উদার প্রকৃতিরও বটে। তাই কোনো গরিব আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুদের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেয়। তেমনি হেলেনও একজন। তাকে বিনা ভাড়ায় এখানে থাকতে দিয়েছেন। সেটাই কি যথেষ্ট নয়। তা নয়, প্রতিবার আমরা সপ্তাহের শেষে এখানে আনন্দ করতে আসব, আর ওকেও তখন ডাকতে হবে, এর কোনো যুক্তি আছে। হতে পারে সে বোন বুও নিজের তো নয়। আলিস্টেয়ার ওর সব দায় দায়িত্ব নেবে তা আমি একেবারে বরদাস্ত করব না।
জেন বলল–বাগান পরিচর্যার কাজ ও খুব দক্ষ হাতে করে। তাই ও ভীষণ অহংকারী।
মিসেস অলিভেরা বললেন সেটাই তো স্বাভাবিক। স্কচরা কারও দাসত্ব গ্রহণ করে না, তাই তাদের সবাই সম্মান করে।
এমন সময় ব্লাস্ট সেখানে এলেন। তিনি পোয়ারোকে সহাস্যে বললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো আমার ঘরে চলুন।
পোয়ারো তাকে অনুসরণ করে ঘরে এলেন। খুবই আরামদায়ক ঘরটি। তবে একটু নীচু। বাগানমুখী দুটি জানালা। বেশ কিছু সোফা ও চেয়ারে ঘরটি সাজানো।
মি. ব্লাস্ট পোয়ারোর দিকে সিগারেট এগিয়ে দিলেন। নিজে একটি পাইপ ধরিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিলেন।
কিছুক্ষণ নীরবে কেটে গেল। এরপর মি. ব্লাস্ট বললেন এবার কাজের কথায় আসা যাক, মঁসিয়ে পোয়ারো। আমি মিস সেইনসবারি সীলের কথা আপনার কাছ থেকে জানতে চাইছি। পুলিশ প্রশাসন তার সম্পর্কে অনুসন্ধান চালাতে আর রাজি নয়। এর পিছনে কি কারণ আছে আমার জানা নেই। তাছাড়া অ্যালবার্ট চ্যাপম্যান কে, তার অভিসন্ধি কি সে বিষয়েও আমি ওয়াকিবহাল নই। ভিতরের ব্যাপার আমার জানা নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এটা খুশি মনে নিচ্ছেন না। তিনি প্রচার বন্ধ করতে বলেছেন। যাতে জনসাধারণের মনে এই ঘটনাটা রেখাপাত করতে না পারে, সেইজন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছেন। এসবই হল সরকারি নিয়মকানুন। সেই মেনে পুলিশও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। মি. ব্লাস্ট পোয়ারোর সামনে এগিয়ে এসে বললেন, সে যাইহোক, আমি প্রকৃত সত্য জানতে চাই। তাই এই কাজটার দায়িত্ব আপনার হাতেই সঁপে দিলাম, মঁসিয়ে পোয়ারো। সরকারি নিয়মকানুনে আপনার হাত বাঁধা পড়েনি। তাই আপনি স্বাধীনভাবে এই কাজটি করতে পারবেন।আমি কি করতে পারি মি.-ব্লাস্ট? আপনি মিস সেইসনবারি সীলের খোঁজ করুন। মৃত অথবা জীবিত যে অবস্থায় পান তাকে জনসমক্ষে নিয়ে আসুন। দু-এক মিনিট নীরব রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন। আমি নিশ্চিত মিস সীল মারা গেছেন। মি. ব্লাস্ট গম্ভীর গলায় বললেন–আপনি কি করে জানলেন মিস সীল মারা গেছেন। এর কোনো প্রমাণ রয়েছে আপনার হাতে। পোয়ারো হেসে বললেন–আপনাকে এখন বোঝাতে পারবনা। তবে বলি মিসেস চ্যাপম্যানের ঘর থেকে একজোড়া নতুন মোজা পাওয়া গেছে। এটাই আসল কারণ, মি. ব্লাস্ট।