মি. মর্লের ছোকরা চাকরটা ফিরে এল আবার, সে ভদ্রলোকটিকে ডেকে ভেতরে নিয়ে গেল। ভদ্রলোকটির নাম কর্নেল অ্যাবারোক্ৰম্বি। এমন অদ্ভুত নাম পোয়ারো কোনোদিন শোনেননি। তিনি ভাবছিলেন এমন নাম মানুষের হয়। এমন সময় একটি ত্রিশ বছরের যুবক ঘরের ভেতরে এসে ঢুকল।
যুবকটি টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। একটা পত্রিকার পাতা ওল্টাতে লাগল। তার ভাবভঙ্গিতে অসহিষ্ণুতা ঝরে পড়ছিল। পোয়ারো আড়চোখে তা জরিপ করছিলেন। তার চেহারার মধ্যে ঔদ্ধতা ও দুর্বিনীত ভাব ফুটে উঠেছে তবে সাংঘাতিক কোনো খুনি বা চক্রান্তকারী বলে মনে হল না মি. পোয়ারোর। তিনি তার কর্মজীবনে অনেক খুনীদের গ্রেপ্তার করেছেন। তিনি ঝানু গোয়েন্দার চোখ দিয়ে যুবকটিকে জরিপ করতে চাইলেন।
ছোকরা চাকর আবার ফিরে এসে বলল–মি. পোয়ারা দয়া করে আসুন। ডাক পেয়েই পোয়ারো উঠে বাইরে বেরিয়ে এলেন। চাকরটি পথ দেখিয়ে নিয়ে এল হলঘরের পেছনে। সেখানে একটা এলিভেটর ছিল। তাতে করে দু’জনে তিনতলায় এসে বারান্দা পেরিয়ে একটা ঘরের সামনে এসে থামলেন, ছোকরা দরজায় টোকা দিল। উত্তরের অপেক্ষা না করে দরজা খুলে দিল। ইশারায় পোয়ারোকে ভেতরে যেতে বলল।
ছোট্ট ঘর। পোয়ারো ঘরে ঢুকলেন। কল থেকে জল পড়ার শব্দ তার কানে এল। তার চোখ গেল দেয়ালের সামনে থাকা একটা বেসিনের দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে মি. মর্লে হাত ধুচ্ছেন। মি. মর্লের চেম্বারে আসার আগে এরকুল পোয়ারো নিজেকে শ্রেষ্ঠ মানুষ, অকুতোভয় বীরপুরুষ বলেই মনে করনে। তবে ঠিক এই মুহূর্তে নিজেকে আর শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করতে চাইছিলেন না, বসে ভয়ে তিনি কাঁপছিলেন। নিজেকে তখন অতি সাধারণ, ভীরু, হতভাগ্যদের সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছে করছিল।
ইতিমধ্যে মি. মর্লে তার পেশাদারি কাজকর্ম শেষ করেছেন। অভ্যাসবশত রোগীর মনের জোর বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করলেন। নানা গল্পগুজবে পোয়ারোকে আনমনা করে রাখলেন।
কথা বলতে বলতে রোগীকে নির্দিষ্ট আসনের দিকে নিয়ে এলেন। আসনে বসতে সাহায্য করলেন। বললেন–মি. পোয়ারো আরাম করে বসুন। কোনো ভয় নেই। অসুবিধা হলে আমাকে বলবেন।
জোরে শ্বাস নিলেন এরকুল পোয়ারো। বাধ্য হয়েই ডঃ মর্লের হাতে নিজেকে সমর্পন করলেন তিনি। মনে সাহস এনে বললেন–ঠিক আছে, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
তৎপরতার সঙ্গে মি. মর্লে পেশাদারি কর্মকান্ড শুরু করলেন। টেবিলটা সামনে টেনে আনলেন। এক হাতে একটা আয়না আর এক হাতে একটি যন্ত্র তুলে নিলেন।
এরকুল পোয়ারো শক্ত মুঠিতে চেয়ারের হাতল ধরে আছেন। দুচোখ বন্ধ করে হাঁ করে রইলেন।
মি. মর্লে জিজ্ঞাসা করলেন, দাঁতে কি খুব যন্ত্রণা হয়?
হাঁ করা অবস্থায় কোনো রকমে উচ্চারণ করলেন মি. পোয়ারো, না তেমন খুব যন্ত্রণা নেই। কষের দাঁতের পিছনে যে দাঁতটি উঠেছে সেটিই মি. পোয়ারোকে চিন্তায় ফেলেছে। এমনও হতে পারে সেটা মি. মর্লের চোখে পড়েছে। অথবা যন্ত্র ব্যবহার করার মতো তেমন কিছু জটিলতা নেই তার দাঁতের ভেতর। তাই এক্ষেত্রে মি. মর্লের করণীয় কিছু নেই। কিন্তু এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয় যে মি. মর্লের মতো বিশিষ্ট দন্তচিকিৎসকের এমন ভুল হবে।
মি. মর্লে একটার পর একটা দাঁত ঠুকে দেখতে লাগলেন। কোনোটার সম্পর্কে কিছু কিছু মন্তব্যও করছিলেন। ভরাট দাঁতটা ঠুকে বললেন–এটা একটু খয়ে এসেছে দেখছি। অবশ্য মাড়ি বেশ ভালো আছে, চিন্তা করবেন না।
এবার তিনি নিজের পাটির দাঁতগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এক দুই তিন চতুর্থটায় এসে হাত থামালেন। হয়তো খারাপ কোনো দাঁতের সন্ধান পেয়েছেন।
চিন্তিত মুখে মি. মর্লে বললেন–এটাতে একটু গন্ডগোল আছে বলে মনে হচ্ছে, এটা নিশ্চয়ই খুব ভোগাচ্ছে? ঠিক আছে, দেখছি কি করা যায়?
সব দাঁত দেখা শেষ করে মি. মর্লে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। মুখে বিজ্ঞের হাসি। যেন মনে হয় সমাধান সূত্র পেয়ে গেছেন।
মি. মর্লে অভয় দিয়ে বললেন–ঘাবড়াবার কিছু নেই। দু-একটা দাঁত সীল করে দিতে হবে। উপরের পাটির দাঁত ক্ষয়ে গেছে। কিছু ভাববেন না আজকেই সব ঠিক করে দেবো।
মি. মর্লে একটা সুইচ টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে মৃদু একটা শব্দ করে দেয়ালের একটি দিকের আলমারির পাল্লা খুলে গেল। সেখান থেকে একটা ড্রিল মেশিন বের করে আনলেন, তিনি তাতে একটা সুঁচ পড়ালেন।
কাজ শুরু করছি ব্যথা পেলে বলবেন–কথা শেষ করেই মি. মর্লে ড্রিল চালাতে লাগলেন, মি. পোয়ারো বাধা দেবার সুযোগ পেলেন না। বাধ্য ছেলের মতো ওই ভীতিকর কাজ দেখতে লাগলেন। এছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার। যন্ত্রণায় কুঁকরে যাওয়া বা আর্তনাদ করার কোনো অবকাশই ছিল না। যথা সময়ে ড্রিম চালানো বন্ধ করলেন মি. মর্লে। এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে বললেন–কুলকুচো করে নিন। তারপর দাঁতের ফাঁকে কিছুটা তুলো গুঁজে দিলেন।
মি. মর্লে ড্রিলে নতুন একটা সুঁচ পরালেন। আবার চালানোর জন্যে তৈরি হলেন। ড্রিল চালানো ব্যাপারটা মি. পোয়ারোর কাছে যত না যন্ত্রণাদায়ক তার থেকে ভীতিকর বেশি। মি. মর্লে ড্রিল চালাতে চালাতে বললেন জানেন তো আজকে আমাকে সব কাজ সামলাতে হচ্ছে। আমার সেক্রেটারি মিস নেভিল আজ আসেননি। তার এক আত্মীয়ার স্ট্রোক হয়েছে। সেই খবর পেয়ে তাকে দেখতে গ্রামের বাড়িতে গেছেন। আপনি নিশ্চয়ই মিস নেভিলকে ভোলেননি।