বহুতল বাড়িটিতে অনেকগুলো ফ্ল্যাট। তিনতলায় রয়েছে পঁয়তাল্লিশ নম্বর ফ্ল্যাটটি। ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজাতেই জ্যাপ দরজাটা খুলে দিলেন। তার মুখে বিষণ্ণতার ছাপ। তিনি বললেন–আসুন পোয়ারো। যেটা দেখাবার জন্য আপনাকে ডেকে এনেছি সেটা ঠিক আশা করিনি আমি। তবে আপনার একবার দেখা উচিত। পোয়ারো গম্ভীর মুখে বললেন–কিরকম অবস্থায় আছেন?
-একদম মরে কাঠ। মনে হয় একমাস আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।
পোরারো তার ডানদিকে পরিচিত একটা শব্দ শুনতে পেলেন। তিনি শব্দ অনুসরণ করে সেদিকে চোখ রাখলেন।
জ্যাপ বললেন–এখানকার পোর্টার। সে অসুস্থ। রান্নাঘরের পাশের ঘরে সে শুয়েছিল। মৃতদেহ সনাক্তকরণের কাজটা ওকে দিয়েই সারলাম।
তারা বারান্দা দিয়ে এগিয়ে চললেন। পোয়ারোর নাকে একটা দুর্গন্ধ এল। তিনি রুমাল দিয়ে নাক চেপে ধরলেন।
তাঁরা ছোট একটা ঘরে এসে ঢুকলেন। সেই ঘরে রয়েছে ডালা খোলা একটি সিন্দুক।
জ্যাপের ইশারায় পোয়ারো সিন্দুকের দিকে এগিয়ে গেলেন। তার ভেতরে চোখ রাখলেন। প্রথমেই তার চোখে পড়ল পা ও ছাতার বকলস। তখন সেদিনের কথা তার মনে পড়ে গেল। যেদিন মি. মর্লে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। সেদিনও তিনি মিস সেইনসবারি সীলের এই বকলসই দেখেছিলেন। একে একে তার নজরে এল সবুজ পশমি কোর্ট, স্কার্ট ও মাথা। দৃশ্যটা দেখে তিনি আঁতকে উঠলেন। তার মুখ দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বের হল।
মৃতার মুখ শক্ত ও ভারী কোনো বস্তুর আঘাতে থেতলে গিয়েছিল। তাতে পচন ধরায় আরও বীভৎস রূপ নিয়েছিল। দুজনেই ওই দৃশ্যটা সহ্য করতে না পেরে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
জ্যাপ বললেন, আজ সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম এই নিয়ে। আমরা এসবে অভ্যস্ত। বেশ বুঝতে পারছি আপনার কষ্ট হচ্ছে। সত্যিই দৃশ্যটা বেদনাদায়ক। পাশের ঘরে বসবেন চলুন। ওঘরে ব্র্যান্ডি রাখা আছে। একটু খেয়ে নেবেন।
পাশের ঘরটা বসবার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ঘরটা সুন্দরভাবে সাজানো, বড় বড় কয়েকটি সোফা ও জ্যামিতিক আকারের আসবাবপত্রে ঠাসা ঘরটি।
পোয়ারো বোতল থেকে কিছুটা ব্র্যান্ডি একটি গ্লাসে ঢাললেন। খানিকটা গলায় ঢেলে তিনি বললেন, এবার বলুন বন্ধু, আমি প্রস্তুত।
জ্যাপ বলতে শুরু করলেন, এই ফ্ল্যাটের মালিক মিসেস অ্যালবার্ট চ্যাপম্যান। বছর চল্লিশের মহিলা। মাথা ভর্তি সোনালি চুল। উদার হাতে টাকা খরচ করেন। ব্রিজ খেলতে ভালোবাসেন, তিনি নিঃসন্তান। তাই একাকীত্ব তার সয়ে গেছে। তিনি একজন বানিজ্যিক পর্যটক। যেদিন আমরা মিস সীলের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছিলাম, সেই দিন সন্ধ্যায় তিনি এখানে এসেছিলেন। পোর্টার তাকে পথ দেখিয়ে ওই ফ্ল্যট নিয়ে গিয়েছিল, তখনই পোর্টারের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল। পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, তার সময়টা মনে আছে তো?
তার অসুখ করেছিল। তাকে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। মাত্র এক সপ্তাহ আগের কথা। সে একটি কাগজের নিরুদ্দেশ কলামে বিজ্ঞাপন দেখে। নিরুদ্দিষ্টার ছবি দেখে ও বিবরণ পড়ে সে মিস সীলকে চিনতে পারে। সে তার স্ত্রীকে বলেছিল, যে মহিলা দোতলায় মিসেস চ্যাপমানের ফ্ল্যাটে রয়েছেন ইনিই সে। এই কাগজের বর্ণনার সঙ্গে ওই মহিলার ছবি, পোশাক একেবারে মিলে যাচ্ছে। এমনকি ওই জুতোর বকলসটা হুবহু এক। মহিলার নামও তখন তার মনে পড়েছিল।
জ্যাপ জোরে শ্বাস নিলেন। আবার শুরু করলেন বলা, পোর্টার লোকটি প্রথমে বুঝতে পারেনি কি করবে? পুলিশে খরব দেবে না গোপন রাখবে। শেষে মনস্থির করে সে পুলিশে জানায়। সত্যিই এখানে একটা চমক লুকিয়ে আছে তা আমি ভাবিনি। আমারতো কর্তব্যে অবহেলা করলে হবে না। তাই সেই লোকটির কথামতো আমি বেড়োর্জকে এখানে পাঠাই। সে খুব ভালো মানুষ। কাজে কর্মে মন আছে। বেডোর্জও অনুমান করেছিল এবার নিশ্চয় কোনো সূত্র পাওয়া যাবে। কেন না আমরা জানতে পেরেছি মিসেস চ্যাপম্যান একমাস ধরে ওই ফ্ল্যাটে আসছেন না। তিনি কোনো ঠিকানাও রেখে যাননি, তার দরজার সামনে বড় বড় করে লেখা : নেমি, একটা বিশেষ কাজে আমাকে হঠাৎ যেতে হচ্ছে। তুমি গোয়ালাকে বলে দিও আর দুধ লাগবে না। আশ্চর্য বিষয় হল তিনি মালপত্র বয়ে দেওয়ার জন্য পোর্টারকে ডাকেননি অথবা ট্যাক্সি ডাকার কথাও বলেননি।
এদিকে মিস সেইনসবারি সীলকে কেউ ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেনি। তবে কি তিনি সকলের চোখের আড়ালে সিঁড়ি দিয়ে নেমেছেন? এটাও অবান্তর প্রশ্ন নয়।
নেমি মিসেস চ্যাপম্যানের পরিচারিকা। সে রোজকার মতো সেদিনও এসেছিল। সে নোটিশ বোর্ডটা দেখেছিল। কিন্তু তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর ঘটেনি। সে জানত মিসেস চ্যাপম্যাম এভাবে বহুবার চলে গেছেন। তাই সে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। সার্জেন্ট বেডোর্জের ইচ্ছে ছিল ফ্ল্যাটে ঢুকে তল্লাশি করার। আমরা একটা সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে গিয়েছিলাম। সেটা ম্যানেজারকে দেখাই এবং ডুপ্লিকেট চাবি চাই। চাবি দিয়ে ঘর খুলে আমরা ভেতরে ঢুকলাম। ঘরের এক কোণে একটা সিন্দুক ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। তবে বাথরুমে লিনোলিয়ামের উপর সামান্য রক্তের দাগ দেখতে পেলাম। তখন আমাদের সন্দেহ আরও বেড়ে গেল। বেডোর্জ বলল, স্যার, আমি নিশ্চিত দেহটা এখানেই আছে। দেহ খোঁজার পালা এবার। বেডোর্জ সিন্দুকের চাবি আবিষ্কার করল। সেই চাবি দিয়ে তালা খোলা হয়। তালা খুলতেই হারিয়ে যাওয়া মিস সীলের দেহ সকলের দৃষ্টিগোচর হল।