নিঃশব্দে ঘরে এসে ঢুকল জর্জ। তার হাতের ট্রে-তে এক কাপ গরম চকোলেট ও কিছু বিস্কুট রয়েছে।
চকোলেটের কাপ ও প্লেট টেবিলে রেখে বলল–স্যার, আর কিছু লাগবে আপনার?
পোয়ারো কাপের চকোলেট নাড়তে নাড়তে বললেন–মনটা বড়ই বিচলিত লাগছে, জর্জ।
তার এই ভাবভঙ্গী জর্জের পরিচিত। তাই সে কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইল। মন যখন অস্থির হয়ে ওঠে, মাথা কাজ করে না তখন তদন্ত সম্পর্কে জর্জের সঙ্গে তিনি আলোচনা করে থাকেন। তিনি বলেন জর্জের বিচার বুদ্ধি অনেক জটিল কেসের সমাধান সূত্র বের করে দিয়েছে।
হঠাৎ পোয়ারো জানতে চাইলেন–আমার দন্তচিকিৎসক হেনরি মর্লের মৃত্যুর খবর তুমি কি শুনেছ, জর্জ?
-হ্যাঁ, স্যার শুনেছি। খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। তিনি নাকি স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরণ করেছেন? হ্যাঁ, আমিও সেরকমই শুনেছি। আসলে তিনি খুন হয়েছেন।
হুঁ, স্যার। –
-এখন কথা হচ্ছে তিনি যদি খুন হয়ে থাকেন, কে খুন করল কে?
–ঠিক কথা, স্যার।
–যাদের ওপর আমার সন্দেহ হচ্ছে তারা হল, রাঁধুনি, পরিচারিকা, মৃতের বোন জর্জিনা মর্লে, মৃতের অংশীদার মি. রেইলি, মৃতের ছোকরা চাকর অ্যালফ্রেড আর হলেন এক গ্রীক ভদ্রলোক। প্রথম ও দ্বিতীয় জনকে আমি ধরছি না। তারা খুব ভাল ও নিরীহ মানুষ। তাদের দ্বারা একাজ সম্ভব নয়। তৃতীয় জন অর্থাৎ মিস মর্লে, যদিও ভাইয়ের সব সম্পত্তির অধিকারী। তবুও অর্থের লোভ বিপদ ডেকে আনে। মি. রেইলির উদ্দেশ্য এখনও বোঝা যাচ্ছে না। ছোকরা চাকরটিকেও সন্দেহ মুক্ত রাখা যাচ্ছে না। তবে বেশি বিপজ্জনক ওই গ্রীক ভদ্রলোকটি।
জর্জ একটু কেশে বলল–এইসব বিদেশীরা, স্যার
এরকুল পোয়ারো তার কথায় সায় দিয়ে বললেন, তুমি ঠিক বলেছ জর্জ, তবে কি জানো, সেই ভদ্রলোক আর বেঁচে নেই। আপাতদৃষ্টিতে মি. মর্লেই তার এই মৃত্যুর জন্য দায়ী। তবে এটা ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত ভুল তা এখনও জানা যায়নি।
আচ্ছা স্যার, এটা হয় না, তারা দুজন দুজনকে খুন করেছেন।
হ্যাঁ, সেটা অসম্ভব নয়। দাঁতের ডাক্তার চেয়ারে বসা রোগীকে মারার পরিকল্পনা করছেন আর এদিকে ওই রোগী ভদ্রলোক তাকে মারার জন্য বন্দুক বের করেছেন। অথচ কেউ তা জানেন না কি ঘটতে চলেছে। এটা একটা বুদ্ধির খেলা। তবে আমার নামের তালিকায় আরও দু’জনের নাম আছে। তাদের মধ্যে একজন এক আমেরিকান ভদ্রলোক অন্যজন ফ্র্যাঙ্ক কার্টার, যদিও সে রোগী হিসেবে আসেনি। সে বারোটার পর ওই বাড়িতে এসেছিল। কিন্তু তাকে কেউ বেরিয়ে যেতে দেখেনি। আমার বক্তব্য তুমি শুনলে, এবার বলো এর থেকে তুমি কি বুঝতে পারলে?
–স্যার, খুনের সময় আপনি জানতে পেরেছেন?
অ্যামবেরিওটিস যদি খুন করে থাকেন তাহলে তা হবে বারোটা থেকে বারোটা কুড়ির মধ্যে। আর যদি অন্য কেউ করে থাকে তাহলে তারপরেই হবে। তা না হলে মর্লের মৃত্যুদেহ অ্যামবেরিওটিসের চোখে পড়ত। এছাড়া বারোটা পঁচিশের পর মি. মর্লে আর কোনো রোগীকে ডাকেননি। তা আমি ওই ছোকরা চাকরের কাছ থেকে জানতে পেরেছি।
জর্জ মাথা চুলকে বলল–স্যার আমি একটা কথা বলব?
হ্যাঁ বলো।
স্যার, কথাটা হল, এবার আপনাকে আর একজন ডাক্তারের সন্ধান করতে হবে।
এরকুল পোয়ারো বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে বললেন–তোমার তারিফ করতেই হবে জর্জ। এই ভাবনাটা আমার মাথায় ছিল না।
জর্জ হাসি মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
পোয়ারো গম্ভীর মুখে একাকী বসে আছেন। মর্লের মৃত্যু রহস্যের জট কিছুতেই খুলতে পারছেন না তিনি। কাকে তিনি চিহ্নিত করবেন খুনি বলে। হঠাৎ মনে পড়ল একটা নাম তালিকা থেকে বাদ গেছে। সেটি হল মি. বার্নেস।
ঠিক সেই মুহূর্তে টেলিফোনটা ঝন ঝন করে বেজে উঠল। জর্জ ছুটে গিয়ে ফোনটা ধরল। তারপর বলল–স্যার আপনাকে একজন মহিলা চাইছেন।
পোয়ারো রিসিভার কানে ধরতেই পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন।
ও প্রান্ত থেকে মহিলা কণ্ঠ–মি. এরকুল পোয়ারো, আমি জেন অলিভেরা, মি. অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের ভাইঝি বলছি। চিনতে নিশ্চয়ই অসুবিধা হচ্ছে না?
–হ্যাঁ, হ্যাঁ চিনতে পারছি বলুন, মিস অলিভেরা।
দয়া করে একবার গথিক হাউসে আসুন। আপনার সঙ্গে ভীষণ জরুরি কথা বলার আছে।
–অবশ্যই যাব। কিন্তু কখন যাব?
সাড়ে ছটায় আসুন।
–বেশ তাই হবে।
জেন অলিভেরা নিচু স্বরে বলল–আপনাকে বিরক্ত করলাম না তো, মঁসিয়ে পোয়ারো?
–একদম না, এটাই আমি মনে মনে চাইছিলাম।
পোয়ারো ফোনটা নামিয়ে রাখলেন। এবার গথিক হাউসে যেতে হবে। তার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা। গথিক হাউসে এসে পৌঁছলেন গোয়েন্দা প্রবর এরকুল পোয়ারো। তাকে একটা বিরাট হলঘরে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে একটা লেখার টেবিলের সামনে বসেছিলেন অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট তাঁর হাতে একটি ছুরি। তিনি আনমনে ছুরিটা নিয়ে খেলা করছিলেন। তাকে খুব অস্থির চঞ্চল মনে হচ্ছিল।
সে ঘরে আরও দুজন মহিলা ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজনকে পোয়ারো চিনতে পারলেন, সে জেন অলিভেরা। জেন একটি ম্যান্টলপীসের সামনে দাঁড়িয়েছিল। অন্য মহিলাকে তিনি চিনতে পারলেন না। তবে যে কথা চিৎকার করে বলছিলেন তা পোয়ারোর কর্ণগোচর হল। তিনি বলছিলেন–এই ব্যাপারে আমার মতামতও জানতে চাওয়া উচিত ছিল, অ্যালিস্টেয়ার।
–অবশ্যই, জুলিয়া অবশ্যই, বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন অ্যালিস্টেয়ার। তিনি পোয়ারোকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বসতে বললেন।