অনাহূতের মতো এরকুল পোয়ারোকে দেখে হাওয়ার্ড রেইকস অস্তুষ্ট হলেন। আগেকার সেই খুনীসুলভ ভাবটা ছিল না। তবুও তিনি বিরক্তি সহকারে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার? আমার এখানে?
এরকুল একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বললেন–বসতে পারি?
রেইকস সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন অবশ্যই বসবেন। ভালো করে বসুন। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। পোয়ারো চেয়ারে বসার পর মি. হাওয়ার্ড প্রশ্ন করলেন আমার কাছে আপনার কি দরকার? আশা করি আপনি আমায় ভোলেন নি, মি. রেইকস?
–কোনো দিন আপনাকে দেখেছি বলে আমার মনে পড়েছে না, মঁসিয়ে পোয়ারা।
–এত ভুলো মন আপনার তা আমি বিশ্বাস করি না। তিনদিন আগে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমরা পাঁচ মিনিটের মতো একসঙ্গে ছিলাম। দন্ত চিকিৎসক হেনরী মর্লের ওয়েটিং রুমে।
দ্রুত যেন কিছু পরিবর্তন ঘটে গেল ভদ্রলোকের চোখে মুখে। অবশ্য তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। তাঁর কথাতেও আবেগ ফুটে উঠল। নিজেকে সংযত করে বললেন–বলুন, আপনার কি বলার আছে?
পোয়ারো এতক্ষণ রেইকসকে সতর্ক দৃষ্টিতে দেখছিলেন। তিনি নিশ্চিত এতক্ষণে লোকটিকে হাতের মুঠোয় আনা গেছে। বোঝা যাচ্ছে তিনি বিপদে পড়েছেন। উদ্ধত চোয়াল রক্তিম দুটি চোখ দেখে মনে হল ঠিক যেন প্রতিহিংসাপরায়ণ এক জন্তু। রেইকস গম্ভীর স্বরে বললেন–আমাকে এসব বাজে কথা বলে কি প্রমাণ করতে চাইছেন আপনি? আমি এসেছি এখানে বলে আপনি ক্ষুণ্ণ হয়েছেন দেখছি।
–আপনার পরিচয় এখনও দেননি মশাই।
দুঃখিত। বলে পোয়ারো তাঁর নাম ঠিকানা লেখা একটি কার্ড রেইকসের হাতে দিলেন। রেইকস কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখলেন তারপর কার্ডটা ফিরিয়ে দিয়ে বললেন–ও! আপনিই তাহলে এরকুল পোয়ারো। বেসরকারী সখের গোয়েন্দা। এই পেশায় আপনার সুখ্যাতি আছে। তবে যাদের প্রচুর টাকা আছে তারাই আপনাকে ডেকে পাঠান। নিজেদের কুকীর্তি চাপা দেবার জন্য আপনাকে ব্যবহার করে।
পোয়ারো স্বর নরম করে বললেন–আপনার কফিটা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি পান করুন।
মি. রেইকস ঈষৎ ঝুঁকে বসে বললেন–আপনার মতলব কি বলুন তো মশাই? কোনো মতলবই নেই, আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম।
ব্যাঙ্গের সুরে রেইকস বললেন–ওহ, তাই বুঝি? তাহলে বলবো আপনি মুখের স্বর্গে বাস করেন। যারা আপনাকে অর্থ দিয়ে নিযুক্ত করেছেন তাদের কাছেই যাওয়া উচিত আপনার। আপনাকে টাকা দেওয়ার মতো সামর্থ আমার নেই, মঁসিয়ে পোয়ারো। পোয়ারো বিমর্ষ সুরে বললেন–টাকা দিয়ে কেউ আমাকে কাজে লাগান নি। রেইকস অবাক হয়ে বললেন–সে কি মশাই, একথা আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন?
পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, বিশ্বাস করা অথবা না করা আপনার ব্যাপার। তবে এটাই সত্যি আমাকে কেউ টাকা দেয়নি এখনও। নিছক কৌতূহল মেটাতে এখানে আসা। তাহলে সেদিন দাঁতের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন কেন? সেও কি কৌতূহল মেটাতে যাওয়া?
পোয়ারা হেসে বললেন মি. রেইকস, আপনি এত জানেন আর এটা জানেন না দন্ত চিকিৎসকের কাছে মানুষ কেন যায়?
–তাহলে দাঁত দেখাতে গিয়েছিলেন?
নিশ্চয়ই।
–মাপ করবেন, কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হল না।
ঠিক আছে, তাহলে আপনিই বলুন কেন দাঁতের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন?
–আপনার কথাতে সায় দিয়ে বলি আমিও দাঁত দেখাতে গিয়েছিলাম।
–আপনি দাঁতের যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছিলেন? অথচ আপনাকে মি. মর্লের ঘরে যেতে দেখলাম না। দাঁত না দেখিয়েই ফিরে এসেছিলেন মি. রেইকস।
মি. রেইকস এবার উত্তেজিত হলেন তিনি কর্কশ স্বরে জবাব দিলেন। যদি চলে আসি তত আপনার কি? আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই চলে এসেছিলাম। আসলে আপনি গিয়েছিলেন প্রখ্যাত সুপ্রতিষ্ঠিত ধনী মানুষটিকে পাহারা দেবার জন্যে। আপনাদের প্রিয় অ্যালস্টেয়ার ব্লাস্ট আশা করি সুস্থ আছেন। আমাকে জালবন্দী করার মতো কোনো যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ আপনাদের হাতে নেই।
পোয়ারো কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে বললেন–সেদিন আপনি চলে আসার পরই ওই বাড়ির কর্তা মারা যান, হয়তো সেটা মনে আছে। রেইকস অবজ্ঞা ভরে বললেন–ওঃ সেই দন্ত চিকিৎসক হেনরী মলে না কি যেন নাম তার!
গম্ভীর স্বরে পোয়ারো বললেন–বাঃ মনে আছে তো। হেনরী মর্লে।
অন্যমনস্ক হয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন মি. রেইকস। তারপর মাথা চুলকে বললেন–এর জন্যে আপনি আমাকে দায়ী করছেন। এবার আপনার আসল মুখোশটা খুলে গেল। আপনার জারিজুরি এখানে চলবে না। আমি ইনকোয়েস্টের রিপোর্ট দেখেছি। বেচারা নিজেকে নিজে গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, ভদ্রলোক ভুলবশত একজনকে অবশ করার ওষুধ অতিমাত্রায় দিয়েছিলেন। ফলে রোগীটি মারা যায়।
পোয়ারো অসহিষ্ণু হয়ে বললেন–আপনি প্রমাণ দিতে পারেন বাড়ি ছেড়ে আপনি যখন বেরিয়ে আসেন তখন আপনাকে কেউ দেখেছে? এমন কেউ কি আছে যে নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করতে পারে বারোটা থেকে একটার মধ্যে আপনি কোথায় ছিলেন?
রেইকস ঘাবড়ে গিয়ে বললেন–একেবারে পাকাপাকি ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। আপনার মতে আমি খুন করেছি। আচ্ছা এতে ব্লাস্টের কাছ থেকে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা পাচ্ছেন আপনি, তাই না?
পোয়ারো ক্রুব্ধ কণ্ঠে বললেন–আপনাকে আমি প্রথমেই বলেছি মি. ব্লাস্ট আমাকে নিযুক্ত করেননি। আমি তার নিরাপত্তার দায়িত্বে আছি।