মিসেস বোলিথো দীর্ঘকায়া, মোটাসোটা চেহারার মহিলা। বয়স চল্লিশের একটু ওপরেই হবে। মিস সেইনসবারি সীলের এক মাথা কোকড়ানো চুল ছাড়া আকর্ষণ করার মত কিছু নেই চেহারার মধ্যে। বয়সেও মিসেস বোলিযথার সমসাময়িক। চশমাটা চোখ থেকে নেমে আসে নাকের ডগায়। অত্যধিক কথা বলেন, যা বিরক্তকর।
মিস সীল আবার বললেন, সত্যি বলছি, ব্যথাটা কমেছে। আর ব্যথাই যখন নেই তখন মিছিমিছি ডাক্তারের কাছে যাব কেন?
মিসেস বোলিথো বাধা দিয়ে বললেন–এই যে বললে গত রাতে ব্যথায় ঘুমোতে পারোনি। তাই তো বলছি এখনই দাঁতটা তুলে ফেলা উচিত। তাছাড়া তুমি নিশ্চয়ই ভীতু নও। মন স্থির করো, ভয় পেও না।
মিস সেমসবারি মনে মনে ভাবলেন–কথাটাতো মন্দ বলোনি, খুব বাহাদুরি দেখাচ্ছ, কিন্তু দাঁত তো আমার, তোমার নয়। মুখে বললেন আপনার কথাই ঠিক, ডঃ মর্লে খুব সাবধানে দাঁত তোলেন। তোলার সময় একটুও ব্যথা লাগে না।
ডিরেক্টর বোর্ডের সভা শেষ। কোনো তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হয়নি। রিপোর্টও খুব ভাল। তবুও স্পর্শকাতর মি. স্যামুয়েল রোদারস্টিন। চেয়ারম্যান মি: অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের হাবভাবে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। (চয়ারম্যানের দু-একটা কথার মধ্যে কিসের যেন একটা ইঙ্গিত ছিল। কিন্তু ভদ্র, মার্জিত, বান মি. ব্লাস্টকে সন্দেহ করতেও মি. রোদারস্টিনের বিবেকে বাঁধছে। অতি সাধারণ একন মানুষ। খাঁটি ইংরেজদের মতো আচরণ করেন। আবেগহীন ভদ্রলোক, তার স্বাস্থ্যও যথেষ্ট ভালো, অর্থকরীর দিক দিয়েও কোনো সমস্যা নেই।
হঠাৎ মি. রোদারস্টিলেন একটা কথা মনে পড়ল তবে কি আমার যকৃতের অসুখটা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে? কিন্তু আমি তো কখনো বলিনি, তবুও আশ্চর্য কিছু ঘটেছে যার জন্য মি. অ্যালিস্টেয়ার এত চিন্তিত;তিনি বারবার আমাকে দেখছিলেন। মাঝেমধ্যে অনমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন; যাই হোক মি. রোদারস্টিন মন থেকে এই গোপন দুশ্চিন্তাটা সরিয়ে দিয়ে বোর্ডরুম থেকে বেরিয়ে এলেন, সঙ্গে রয়েছেন চেয়ারম্যান অ্যালিস্টেয়ার।
তাঁরা দুজনে সিঁড়ি বেয়ে পথে নেমে এলেন।
স্যামুয়েল রোদারস্টিন অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টকে পৌঁছে দিতে চাইলেন।
মি. ব্লাস্ট সামান্য হেসে মাথা নাড়লেন। বললেন-ধন্যবাদ, আমার গাড়ি রয়েছে। আমি শহরে যাব। একবার দাঁতের ডাক্তার মি. মর্লের চেম্বারে যেতে হবে। তিনি ঘড়ি দেখে গাড়িতে উঠে বসলেন।
স্যাভয় হোটেল। মি. অ্যামবেরিওটিস প্রাতরাশ সেরে দাঁত খোঁচাচ্ছিলেন খড়কে কাঠি দিয়ে। তাঁর মুখে জয়ের হাসি। ভাবছিলেন ওই বোকা মেয়েটিকে বোকা বানানো গেছে, দুটো মিষ্টি কথায় মেয়েটি একেবারে গলে গেছে। আমার পাওনাটা বেশ ভালই হবে। তিনি উদারও বটে দুটো পয়সা ছাড়তে কসুর করেননি। অ্যামবেরিওটিসের চোখের সামনে ভেসে ওঠা দৃশ্যটিতে তিনি মজা পেলে, ছোট মেয়ে ডিমিট্রিও কমস্টাস্টোপোপেশাস হোটেলের খদ্দেরদের নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে; এমন সময় খড়কেটা মি. অ্যামবেরিওটিসের দাঁতে খোঁচা লাগতে তিনি ব্যথায় ঝাঁকিয়ে উঠলেন। ভবিষ্যতের রঙীন ছবি ফানুসের মতো উড়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। এবার তিনি কঠিন বাস্তবে ফিরে এলেন। পকেট থেকে একটা নোটবই বের করলেন। পাতা ওল্টালেন। একটা পাতায় তার চোখ থমকে গেল। লেখা আছে বেলা বারোটা, ৫৮ কুইন শার্ট স্ট্রিট। তিনি বারবার এই লাইন দুটি উচ্চারণ করলেন। কিছুতেই তিনি আগের ভাবনাটায় মনোসংযোগ করতে পারছেন না।
৫৮ কুইন শার্লট টি। একটি ট্যাক্সি এসে থামল বাড়িটির কাছে। নেমে এলেন এরকুল পোয়ারো। বাড়িটির বেল বাজালেন।
কিছুটা সময় কেটে গেল। দরজা খুলে বেরিয়ে এল এক চাকর। ছেলেটির বয়স কম, মাথায় চুল, ব্যবহার ভদ্রজনোচিত, অমায়িক হাসি ঠোঁটের কোণে।
এরকুল পোয়ারো মি. মর্লের খোঁজ করলেন। ছোকরা চাকরটি নির্দ্বিধায় তাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন।
এবার ছেলেটি মি. পোয়ারোর নাম জানতে চাইল। মি. পোয়ারো তার নাম বললেন। চাকরটি তাকে ডান দিকের একটা হলঘরে নিয়ে গেল। ঘরটি রোগীদের ওয়েটিং রুম।
এরকুল পোয়ারো চেয়ারে বসে ঘরের চারদিকে চোখ রাখলেন। ঘরটি বেশ সুন্দর ভাবে সাজানো। উন্নতমানের রুচির পরিচয় রয়েছে সেখানে। ঘরের মাঝখানে পালিশ করা চকচকে একটা টেবিল। তার ওপর কিছু পত্রিকা সাজানো। পাশে রয়েছে একটি বাতিদান। ম্যান্টলপীসের ওপর রাখা আছে একটি টেবিল ঘড়ি ও ব্রোঞ্জের ফুলদানি। দরজা জানলায় ঝুলছে নীল মখমলের পুরু পর্দা। লাল রঙের ফুল আর পাখির নকশা করা কয়েকটি চেয়ার রয়েছে। একটি চেয়ারে বসেছিলেন এক ভদ্রলোক তার ঠোঁটের ওপর একজোড়া মোটা গোঁফ, গায়ের রঙ পীতাভ! তিনি পোয়ারোর দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন তিনি কখনো মানুষ দেখেননি। জঘন্য সেই দৃষ্টি। মি. পোয়ারো এসবই লক্ষ্য করেছেন। তিনি অবজ্ঞা ভরে বললেন–এমনকিছু ইংরেজ আছে যারা যতটা কদর্য ঠিক ততটাই হাসির উদ্রেক করে।
ভদ্রলোক বেশ কিছুক্ষণ পোয়ারোকে লক্ষ্য করলেন। তারপর চেয়ারটা ঘুরিয়ে অন্য দিকে ফিরে বসলেন। চোখের সামনে তুলে ধরলেন টাইমস পত্রিকাটি। ভাবখানা এমন মি. পোয়ারের সঙ্গে চোখাচোখি হলে তাঁর মর্যাদাহানি হবে।
মি. পোয়ারো একটা বাঞ্চ পত্রিকা হাতে তুলে নিলেন। পড়ায় মন দিলেন। পাতার পর পাতা ওল্টালেন; কিন্তু লেখাগুলোর মধ্যে হাসির কোনো খোরাক খুঁজে পেলেন না।