শেষ লেখাটা নিয়ে তিনি অনেক ভাবনা চিন্তা করলেন। অবশেষে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন এবং টুপি ও ছড়ি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। এরকুল পোয়ারো মেট্রেরেলে চড়ে এলেন ইলিং ব্রডওয়ে স্টেশনে। সেখান থেকে পাড়ি দিলেন তার গন্তব্যে। এসে পৌঁছলেন ৮৮ ক্যাসলগার্ডেনস রোডে। ইতিমধ্যে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় পার হয়েছে। বাড়িটা ছোট। সামনে সুদৃশ্য বাগান। পোয়ারো গতোক্তি করলেন, চমৎকার পরিকল্পনা, তারিফ করতেই হবে!
এই চমকপ্রদ বাড়ির মালিক মি. বার্নেস, তিনি তাকে নিয়ে ড্রইং রুমে বসালেন।
মি. বার্নেস ঘরের ভেতর এলেন, পোয়ারো সন্ধানী চোখে জরিপ করলেন তাঁকে। ছোটখাটো চেহারার মানুষ। কেশবিহীন মাথা। চোখে চশমা। চশমার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঝকঝকে দুটি চোখের তারা। ভদ্রলোকের হাতে রয়েছে তার দেওয়া কার্ডটি।
মি. বার্নেস হাসি মুখে বললেন–আপনিই মঁসিয়ে পোয়ারো? আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি।
পোয়ারো লজ্জিত হয়ে বললেন–না জানিয়ে হঠাৎ এসে পড়ার জন্য আমি লজ্জিত ও দুঃখিত, মি. বানেস।
না, না, এভাবে বলবেন না। এখন পৌনে সাতটা বাজে। কাউকে বাড়িতে পাওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। দয়া করে আপনি বসুন, মঁসিয়ে পোয়ারো। বোধ হয় আপনি ৫৮ কুইন শার্ট স্ট্রিট সম্পর্কিত কিছু উত্তর খুঁজতে এখানে এসেছেন? আমি আপনাকে অনেক তথ্য দিতে পারব আশা করি।
পোয়ারো বললেন–আপনার অনুমান সঠিক। তবে আমি যে মি. মর্লের মৃত্যুর কথা বলতে এসেছি তা আপনি বুঝলেন কি করে?
বার্নেস হেসে বললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি স্বরাষ্ট্র দপ্তরে উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলাম। যদিও অতি সম্প্রতি আমি অবসর গ্রহণ করেছি–তবুও আমার বুদ্ধি এখনও ভোতা হয়ে যায়নি। কোনো গোপনীয়তা থাকলে পুলিশের কাছে না গিয়ে গোয়েন্দাদের কাছেই যাওয়া উচিত, ঠিক বলিনি?
পোয়ারা বললেন–এতে গোপনীয়তার কি আছে? ভদ্রলোক চশমা খুলে হাতে রাখলেন। সামনের দিকে ঝুঁকে এসে বসলেন। বললেন–সিক্রেট সার্ভিসে কেউ চুনো পুঁটির খোঁজ করে না, তাদের খোঁজ নিতে অনেক সময় পুঁটিমাছের দ্বারস্থ হতে হয়।
দেখছি আমার চেয়ে আপনার পারিপার্শ্বিক জ্ঞান অনেক বেশি, মি. বার্নেস। আসলে আমি কিছু জানি না। কেবল দুয়ে দুয়ে চার করার চেষ্টা চালাচ্ছি।
সেই দুইটা কি?
মি. বার্নেস তীক্ষ্ণস্বরে জবাব দিলেন অ্যামবেরিওটিস। আপনি নিশ্চয়ই ভোলেন–নি, মিনিট কয়েকের জন্যে হলেও আমাকে তার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তিনি আমাকে কোনো দিন দেখেননি এবং চেনেন না। কিন্তু আমি ওর সম্পর্কে সবই জানি। তিনি এদেশে কেন এসেছিলেন তাও বলতে পারি।
-কেন? পোয়ারোর ছোট্ট প্রশ্ন।
–এদেশে আমাদের মানুষ হিসেবে অনেকে পছন্দ করেন না। রক্ষণশীলতাই আমাদের ধর্ম। আমরা যতই আমাদের গণতান্ত্রিক সরকারের সমালোচনা করি না কেন নতুন কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সাহস পাই না। বিদেশীদের এখানেই গাত্রদাহ। তাদের কষ্ট। তারা মনে মনে ভাবে ইংল্যাণ্ডের মতো ধনী দেশ ইউরোপের আর কোথাও নেই। তাই আমাদের দেশকে বিপদে ফেলতে পারলে তাদের আনন্দ হবে। তার জন্য প্রয়োজন ইংল্যাণ্ডের ভিত ধরে নাড়া ও অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়া। কিন্তু কাজটা খুবই কঠিন। কেন না এর শীর্ষ নেতৃত্বে আছেন অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের মতো মানুষ।
একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন মি. বার্নেস। অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের চরিত্র এমন যিনি সর্বদা নিজের সীমার মধ্যে বিচরণ করেন। তা তার কাছে যত টাকা থাকুক কেন। অকারণ ব্যয় তিনি পছন্দ করেন না। তাই তার ধারণা দেশের সব মানুষের উচিত তার মতো জীবন যাপন করা। আর সেই কারণেই কেউ কেউ চাইছে মি. ব্লাস্টকে সরিয়ে দিতে।
–আশ্চর্য!
মাথা নেড়ে মি. বার্নেস বললেন–আশ্চর্যই বটে। একদল মানুষ নতুন পৃথিবী গড়ার রঙিন স্বপ্ন দেখছে। কুৎসিত চেহারার, কদাকার মনের একদল মানুষ আছে যারা বিদেশী ভাষায় তর্ক করতে ভালোবাসে। তৃতীয় আরেকদল আছে যারা কেবল কথা বলতে পটু। তবে এদের মধ্যে একটা মতের মিল তা হল ব্লাস্টকে সরে যেতে হবেই।
পোয়ারো মনযোগ সহকারে বার্নেসের কথা শুনছেন। বার্নেস থামতেই বলে উঠলেন, তারপর। বার্নেস পাবার শুরু করলেন–পুরানো নিয়মকানুন ভেঙে ফেলার মূলে আছে টোরি, রক্ষণশীল, পোড় খাওয়া মানুষ ও লোভী ব্যবসাদাররা। হয়তো এরা সবাই ঠিক। আমরাও স্থির বিশ্বাস পুরনো নীতি পাল্টে এমন কিছু করতে হবে–যেটা মানুষের উপকারে লাগবে। এমন কিছু করতে হবে যাতে বাড়িটা ধ্বংস হয়ে যায়। আর ওই বাড়ির ভিত হচ্ছেন ব্লাস্ট। তাই ওরা চাইছে ব্লাস্টের ক্ষতি করতে। আমি নিশ্চিত জানি গতকাল সকালে ওরা তাকে খতম করার চেষ্টায় ছিল। এ চেষ্টা ওরা এর আগেও করেছিল, পারেনি।
বার্নেস একটু থেমে দম নিলেন। তারপর আবার শুরু করলেন। আমি তিন জনের কথা বলছি। একজন খ্যাতিমান চ্যান্সেলর আর এক্সরে করে দ্বিতীয়জন দূরদশী উৎপাদক এবং তৃতীয়জন উৎসাহী তরুণ রাজনীতিক। অবশ্য আজ এরা কেউই নেই। সবাই মারা গেছেন। তাদের মৃত্যুর পেছনে যাদের হাত ছিল তারা হলেন একজন সার্জন ও অন্যজন ডাক্তার, সার্জেনের ভুল চিকিৎসার জন্য প্রথমজন অপারেশন টেবিলে মারা যান। দ্বিতীয়জন মারা যান ডাক্তারের নির্বুদ্ধিতার কারণে। তৃতীয় জন মারা যান গাড়ি চাপা পড়ে। সেই দোষী সার্জন বর্তমানে একটি গবেষণাগারের মালিক। ডাক্তার অবসর গ্রহণ করে একটি চমৎকার হয়টর গড়ে তুলেছেন। আমরা সবাই জানি প্রত্যেক জীবিকায় লোভের হাতছানি আছে, বেশির ভাগ মানুষ তাতে সাড়া দেয়। তবে মর্শে সে ধরনের লোভী ছিলেন না। এটা ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ কাজ।