জ্যাপ ঘড়ি দেখলেন। বললেন–মি. অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট সওয়া চারটের সময় দেখা করতে বলেছেন। চলুন আমরা প্রথমেই তার কাছে যাই। তারপর সাক্ষাৎ করব সেমস বারি সীল-এর সাথে। এরপর যাব গ্রীক বন্ধু অ্যামবোরিওটিসের কাছে। ওর কাছে যাবার আগে আমাদের খুঁটিনাটি সবকিছু জানতে হবে। সবশেষে আপনার ভাষায় খুনির মতো চেহারা ওই আমেরিকানের সাক্ষাৎ প্রার্থী হবো।
পোয়ারো মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
জ্যাপ আবার বললেন–তাছাড়া আমার মিস নেভিল ও তার তরুণ বন্ধুর সম্পর্কেও আরও ভালোভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। এদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিশ্চয়ই আমরা একটা সমাধান সূত্রে পৌঁছতে পারব।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট, যিনি কখনোই প্রচারের আলোয় আসেননি। তিনি অত্যন্ত সাধারণ একজন মানুষ। তিনি একাকী জীবন কাটাতে অভ্যস্ত। তাই তিনি রাজা না হয়েও রাজপরিবারের সদস্য হিসেবেই জীবন কাটিয়েছেন।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের স্ত্রী রেবেল ম্যানসেভেরেটো। তাকে লোকে আর্মহোল্ট নামেও চেনে। তিনি লন্ডনে প্রথম আসেন পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে। অর্থের অভাব নেই। প্রচুর সম্পত্তি, টাকাপয়সা পেয়েছিলেন তিনি বাবা ও মায়ের থেকে। রেবেলের মা ইউরোপীয়ান। তিনি রোদারস্টাইন পরিবারে জন্মান। তাঁর বাবা আমেরিকার সুপ্রসিদ্ধ ব্যাঙ্কার। আমেরিকার সন্তান রোবেল আর্নহোল্টের দুই ভাই। তারা বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। এরপর ওই পরিবারের বিপুল সম্পত্তির একচ্ছত্র দাবিদার হন তিনি। ইউরোপের এক বিখ্যাত ব্যক্তি দ্য ম্যানসেভেরেটোর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, অবশ্য সে বিয়ে স্থায়ী হয়নি। তিন বছর পরে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। একমাত্র মেয়ে ও বৈবাহিক সূত্রে পাওয়া অর্থ নিয়ে তিনি চলে আসেন, এক শয়তানের প্রেমের জালে জড়িয়ে পড়েন তিনি। লোকটি অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির। তার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দু’বছর পর চলে আসতে বাধ্য হন তিনি। কয়েক বছর পর তিনি মেয়েটিকেও হারালেন। সে রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায়। জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি পারিবারিক ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করলেন। তার সমস্ত অর্থ ও মস্তিষ্ক পিতার ব্যাঙ্কিং ব্যবসায় লাগালেন।
ইত্যবসরে রোবেলের পিতার মৃত্যু হয়। তিনি অর্থনৈতিক জগতে এক ধনী মহিলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। তার প্রতিভা ও ক্ষমতা ছিল অতুলনীয়। লন্ডনে আসার পর আলাপ হয় অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের সঙ্গে। তখন মি. ব্লাস্ট লন্ডন হাউসের একজন জুনিয়ার অংশীদার ছিলেন। তিনি কিছু কাগজপত্রসহ দেখা করতে এসেছিলেন রোবেলের সঙ্গে। ইতিমধ্যে দুছ-ছটি মাস কেটে গেছে। হঠাৎ একদিন সারা লন্ডনের মানুষ জানতে পারল রেবেল ম্যামসেভেরেটো অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টকে বিয়ে করছেন। আরও বেশি মুগ্ধ হন সবাই এই কথা শুড় ব্লাস্টের থেকে তিনি প্রায় কুড়ি বছরের বড়।
যথারীতি এ খবর সকলের মুখে মুখে ঘুরতে লাগল। সবাই ব্যাপারটা নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগল। রোবেলের বন্ধুরা বলাবলি করতে লাগল, রোবেল অত্যন্ত মুখ, সে এখনও পুরুষ চিনতে শেখেনি। ব্লাস্ট ওকে টাকার লোভে বিয়ে করেছে। আবার একটা চরম আঘাত না পেলে ওর শিক্ষা হবে না।
আবার অনেকের অনুমান ব্লাস্ট রোবেলের টাকাপয়সা অন্য নারীর পেছনে খরচ করবে। সকলের ভবিষ্যৎ বাণী বৃথা হয়েছিল। তাদের দাম্পত্য জীবন সুখেই কেটেছিল। ব্লাস্ট স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসতেন। স্ত্রীর প্রতি অনুরাগের ঘাটতি ছিল না। রেবেলের মৃত্যুর পর তার বিপুল ঐশ্চর্য সযত্নে রক্ষা করে চলেছেন। কোনো ভাবেই নষ্ট হতে দেননি। অথবা তিনি রোবেলকে ভুলে আরেকজনকে বিয়েও করেননি। এত অর্থকড়ি হাতে পেয়েও তিনি উচ্চুঙ্খল জীবন যাপন করেননি। অর্থনৈতিক বিষয়টা তিনি ভালোই বুঝতেন। বিচারবুদ্ধি ও কার্য ক্ষমতায় বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। ব্লাস্ট আমহোস্ট ও রোদারস্টাই নের বিশাল সম্পদ দক্ষতা ও নিপুন হাতে বজায় রেখেছেন। তাই তিনি এত সুনাম অর্জন করেছেন।
ভেল্টে ও নরফোকে বাড়ি ছিল। সেখানে তিনি ছুটির দিনগুলি কাটাতেন। তিনি হৈ চৈ বেশি পছন্দ করতেন না। কারো সঙ্গে বেশি মেলামেশাও করনে না। তার গুটিকয়েক বন্ধু ছিল। তিনি অল্প খেলতে ভালোবাসতেন। এছাড়া বাগান পরিচর্যার কাজেও তিনি সমান দক্ষা ছিলেন। এমনই একজন ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎপ্রার্থী হতে চলেছেন দু’জনে চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ এরকুল পোয়ারো।
তারা একটি ট্যাক্সিতে চড়ে এসে হাজির হলেন বেলমির সাগরবেলায়। তীরবর্তী বিশাল প্রাসাদটি সত্যিই মনোরম নয়নাভিরাম। এর ভেতর সহজসরল হলে কি হবে প্রাচুর্যের অভাব নেই এখানে। হয়তো আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি কিন্তু খুবই আরামপ্রদ খুবই জনপ্রিয় এই প্রাসাদটি।
তারা প্রাসাদের ভেতর প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই মি. ব্লাস্ট এসে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ করলেন।
জ্যাপ ও পোয়ারোর পরিচয় পর্ব শেষ হলে ব্লাস্ট বললেন, মি. পোয়ারো, আপনার নামের সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় হয়েছে। তবে কোথায় যেন আপনাকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করেছি, ঠিক মনে পড়ছে না। পোয়ারো হেসে উত্তর দিলেন, আজ সকালেই আমাকে দেখেছেন, মঁসিয়ে। দাঁতের ডাক্তার মি. মর্লের ওয়েটিং রুমে। এবার মনে পড়ছে? ব্লাস্টের মুখেও হাসি ফুটেছে। তিনি বললেন, তাইতো, আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম। দেখেছি দেখেছি মনে করতে পারছিলাম না। জ্যাপের দিকে নজর পড়ল তার। তিনি জানতে চাইলেন, আমি কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি মি. জ্যাপ। মর্লের ব্যাপারে আমি শোকাতুর।