…এবার তৃতীয় খুন অর্থাৎ আপনার দাদার পালা। আপনি এক্ষেত্রে একটু চালাকির আশ্রয় নিলেন। চিঠিটা যাতে আমি দেরিতে পাই তার ব্যবস্থা করলেন।…আপনি আমাকে কেন চিঠি পাঠান? এর জবাব খুঁজতে খুঁজতে আবিষ্কার করলাম, দুটি কারণে আপনি আমাকে চিঠি পাঠান। প্রথমত, আমাকে এবং গোয়েন্দা দপ্তরকে এ.বি.সি. রহস্য সম্বন্ধে সচেতন করতে। দ্বিতীয়ত, আমার নামকে মূলধন করে তার এক অদ্ভুত মনোবাসনা পূরণ করতে…এখানে আপনি যদি আপনার পরিকল্পনামাফিক খুন না করেন তাহলে আপনাকে সন্দেহ করা যেতে পারে। তাই কায়দা করে আপনি ঠিকানা ভুল করে চিঠি দেরি করে পাঠালেন। ততক্ষণে আপনি আপনার কর্ম সমাধা করে ফেলবেন। এই তিন নম্বর হত্যা সম্পূর্ণ করার পর আলোচনা থেকে আপনি বুঝতে পারলেন, সন্দেহের ঊর্ধ্বে আপনি আছেন। দেখলেন, পুলিশ আর বসে নেই। জোর কদমে কাজ শুরু করে দিয়েছে। আপনি তাই নিয়মের ব্যতিক্রম করে চার নম্বর অক্ষরের পরিবর্তে পাঁচ নম্বরকে বেছে নিলেন শিকার হিসেবে।
…এরপর আমরা সদলবলে ডন কাস্টারে গিয়ে হাজির হলাম। আপনিই এই পরামর্শ দিয়েছিলেন। এদিকে অপনার নির্দেশমতো কাস্টও সেখানে এসে হাজির। সে এখানে কোথায় থাকবে সেটা আপনার আগেই জানা ছিলো। সেদিন আপনার একটা উদ্দেশ্য ছিল যেভাবে হোক খুন করতেই হবে এবং কাস্টকে সেই খুনের জন্য দোষী সাব্যস্ত করতে হবে। কাস্ট সিনেমা হলে ঢুকতে আপনিও তার পেছন পেছন ঢুকে পড়লেন। ইচ্ছে করে মাথা থেকে টুপিটা ফেলে দিলেন এবং খোঁজার অছিলায় সামনের সারির দিকে ঝুঁকে পড়ে ছুরিটা ঢুকিয়ে দিলেন। ব্যাস, কাজ শেষ।
…কাগজে কাগজে খবরগুলো প্রকাশিত হলো। কাস্টের নজর এড়ালো না। সে মনে করেছিল যেহেতু তিনটি খুনের ক্ষেত্রে সে ঐসব ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল, তাই লোকে তাকে খুনী মনে করছে। অনেক সময় দেখা গেছে, দুর্বল মানুষ নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, তার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হলো না। এমন সময়ে তার কাছে চতুর্থ নির্দেশ এলো ড কাস্টারে যাওয়ার। সে কিছু বুঝতে না পেরে ইচ্ছাকৃতভাবে বেরোনোর সময় সে মিথ্যে কথা বললো মিসেস মার্থারিকে, যে সে বেলতেন হ্যাঁমে যাচ্ছে।
…তারপর ডন কাস্টারের কাজ শেষ করে সিনেমা হল থেকে ফিরে যখন নিজের জামার আস্তিনে রক্ত ও পকেটে ছুরি দেখে তখন তার সমস্ত চিন্তাভাবনা সত্য বলে মনে হলো। তখন তার কেবল একটাই কথা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো, আগের তিনটি মৃত্যুর জন্য সে-ই দায়ী।…হতাশা, ভয়ে সে কুঁকড়ে উঠলো। সে পাগলের মতো ছটফট করতে লাগলো। একটু শান্তির আশায় সে ক্যামডেনের বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে নিজেকে বন্দী করলো। ভাবলো একটু স্বস্তি পেলো। ক-দিন ঘর থেকে বাইরে বেরোলো না। কেবল একই চিন্তায় ডুবে রইলো। ছুরিটা আলনার পেছনে লুকিয়ে রাখলো, তবু কি শান্তিতে থাকতে পারছে? এমনই যখন উথালপাথাল অবস্থা তখনই ভগবানের নির্দেশের মতো ফোনে কে যেন বললো, পালিয়ে যেতে। দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো পথে। কিন্তু কোথায় যাবে? তখন খেয়াল হলো, থানার উঠোনে এসে হাজির হয়েছে। অজানা আতঙ্কে তার শরীর কাঁপতে লাগলো, জ্ঞান হারিয়ে সেখানে পড়ে গেলো।
…তাকে থানায় প্রথম দিন দেখে আমার ধারণা হয়েছিল, এই লোকের পক্ষে খুন করা সম্ভব নয়, আততায়ী হতে পারে না। অবশ্য সে নিজের মুখে স্বীকার করেছে যে চারটি খুনের নায়ক সে নিজে। কিন্তু ওর স্বীকারোক্তি থেকে আমার যুক্তির বুনিয়াদ আরো মজবুত হলো।…
-ভারি তো যুক্তি, তার আবার বুনিয়াদ। ফ্রাঙ্কলিন তাচ্ছিল্যভাবে বললো।
–এ্যান্ডোভার এবং কার্স্টনের খুনের জন্য যে হাতিয়ার ব্যবহার করা হয়েছিল সেটি আমি বাইরের ঘরের আলমারিতে দেখেছি, যেদিন লেডি ক্লার্কের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।…আর সেদিন সিনেমা হলের দারোয়ান থেকে শুরু করে টিকিট চেকার–সবাই আপনাকে ছবি শেষ হওয়ার প্রায় দশ মিনিট আগে হল থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। বেক্সহিলের মিলি হিগলি জিঞ্জার ক্যাটে বেটির সঙ্গে যাকে কথা বলতে দেখেছিল, সে আপনি স্বয়ং।…আর কাস্টের কাছে পাঠানো টাইপ রাইটার মেশিনে কম করে দশটা চাবিতে আপনার হাতের ছাপ পাওয়া গেছে।
-মঁসিয়ে পোয়ারো, চ্যালেঞ্জ করেছিলাম, আপনিই জিতলেন। এই বলে ফ্রাঙ্কলিন নিজের পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করে নিজের কপাল লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপলো। কিন্তু রিভলবার থেকে কোনো গুলি বেরোলো না।
পোয়ারো হেসে উঠলো।
-মঁসিয়ে ফ্রাঙ্কলিন, আপনার হাতে ঐ যন্ত্র আর কাজ করবে না। আমার নতুন কাজের ছেলেটি সুযোগ বুঝে আগেই আপনার পকেট থেকে রিভলবার নিয়ে গুলি বের করে রেখেছে।
ফ্রাঙ্কলিনের আর কিছু করার নেই। সে রাগে উত্তেজিত হয়ে উঠলো। পোয়ারোকে গালমন্দ করতে লাগলো।
পোয়ারো হাসতে হাসতে বললো, মিঃ ফ্রাঙ্কলিন, নিজের মনকে কখনও ভুলেও ছোটো ভাববেন না।
পাশের ঘর থেকে ক্রোম, জ্যাক এসে ঢুকলো। ফ্রাঙ্কলিন লজ্জা অবনত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। তারা ফ্রাঙ্কলিনকে নিয়ে চলে গেল।
ঘরে নেমে এলো এক চরম নিস্তব্ধতা। একসময় মেগানের ফিসফিসানি শোনা গেল:..এতক্ষণ দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম। বিশ্বাস হয় না। কিন্তু
–সব জানি আমি, মাদমোয়াজেল, আপনার মনের আশঙ্কাটা নিতান্তই অমূলক। মঁসিয়ে ফ্রেসার আর যাই করুক খুন করার মতো মানসিকতা তার নেই।