কি এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় তার মুখ কুঁকড়ে উঠলো। ঠোঁট দুটো কেঁপে কেঁপে উঠলো–কি যন্ত্রণা…এক বিরাট শূন্যতা।
আমি সুযোগ বুঝে প্রশ্ন করলাম, কিন্তু আপনি কি অস্বীকার করতে পারেন, আপনি খুন করেন নি? কেন করেছেন? আপনার কি উদ্দেশ্য
মুখ বিকৃত করে বললো–জানি না, আমি খুন করিনি। কেন খুন করেছি, সেটাও আমার অজানা।
কাস্টের সঙ্গে পোয়ারোর কথোপকথন আমরা সকলে মন দিয়ে শুনলাম। এবার পোয়ারো আমাদের ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেবে, কিভাবে সঠিক সমাধানে সে উপনীত হলো।
বিবৃতি শুরু করলো পোয়ারো–যেদিন থেকে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে সেদিন থেকে অর্থাৎ গত কয়েক মাস ধরে আমি কেবল মনের মধ্যে একটি খোঁচা অনুভব করতাম, কেন এই খুন?… তাছাড়া খুনীর আসল পরিচয় কি, সেটাও আর একটি বড় প্রশ্ন। আপনারা হয়তো বলবেন, লোকটি উন্মাদ, অপ্রকৃতিস্থ, কার্যকারণ সম্পর্কে মাথা ঘামাবার মতো শক্তি তার নেই। কিন্তু আমি বলবো, ঠিক এর উল্টো। একজন সুস্থ মানুষ যতখানি যুক্তিবাদী হয়ে থাকে। একজন পাগলও ভেতরে ভেতরে ততখানি হয়। আমাদের তার দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখতে হবে। তবেই আমরা সেই যুক্তির তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারব। নতুবা প্রতিটি কাজ আমাদের সৃষ্টিছাড়া…আমাদের অপরাধীটি এক বিচিত্র মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ। একদিকে যেমন যুক্তিবাদী তেমনি যুক্তিহীন, নিয়মমাফিক এবং নিয়মছাড়া। পরম বিবেচকের মতো সে যেমন প্রতিটি খুনের আগে চিঠি দিয়ে এরকুল পোয়ারোকে সতর্ক করেছে। তেমনি নিজের খেয়ালে একটা একটা করে চারটে খুন করতে পেরেছে।…আসলে লোকটির মনে দ্বি-মানসিকতা বাসা বেঁধে আছে। রহস্যের সমাধানে এটাই জটিলতা সৃষ্টি করেছে। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, একই মানুষের মধ্যে এত বিরোধিতা থাকতে পারে। তাই প্রথম চিঠি পেয়ে আমি বুঝতে পেরেছিলাম এর মধ্যে কোনো গোলমাল আছে…। কিন্তু মিসেস এ্যাম্বার-এরপর থেকে যে খুনগুলো হলো সেখানে আমি মাথা ঘামালাম না যে কে খুনী। তার স্বরূপ কি, খুনের অন্তরালে তার মোটিভই-বা কি?..কিন্তু ধীরে ধীরে আমার হাতে কিছু কিছু সূত্র এসে পড়তে লাগলো।
শুধু নিজের নাম জাহির করা যে খুনীর উদ্দেশ্য তা মোটেও নয়। তাহলে সংবাদপত্র অফিস বসে থাকতো না। এরকম কয়েকটা চিঠি পেলে তারা নিশ্চয়ই ছাপাতো। কিন্তু দ্বিতীয় চিঠিটা পাওয়ার পর অর্থাৎ মিস বার্নার্ডের মৃত্যু রহস্য আমাদের এক নতুন তথ্যের সন্ধান দিলো। অবশ্য কিছু করতে পারিনি আমরা। কিন্তু আবিষ্কার করলাম বর্ণমালার অক্ষর ধরে একের পর এক খুন অনুষ্ঠিত হবে। ততদিনে নতুন আর একটি প্রশ্ন উদয় হলো–কেন এ.বি.সি. এমন নারকীয় হতা চালিয়ে যাচ্ছে? সে কি কেবল খুন করার তাগিদেই এমন বীভৎস কাণ্ড ঘটিয়ে যাচ্ছে? প্রশ্নে প্রশ্নে আমার মন জর্জরিত হয়ে উঠলো। কে যেন আমাকে বার বার বললো, পোয়ারো খুনীকে জানার চেষ্টা করো। কেন শুধু শুধু তার রহস্যের টানাপোড়েনের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছো? কেবল একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, খুনী তার ক্ষমতার মধ্যে যতটুকু করতে পারে তাতেই সে সন্তুষ্ট, সে খুশী।…এ.বি.সি. গাইড আমরা প্রত্যেকটা খুনের জায়গায় পেয়েছি। তাতে ভাবলাম, খুনীর হয়তো ভ্রমণের নেশা আছে। আর একটা করে গাইড নিহত ব্যক্তির পাশে ফেলে আসা হয়তো তার মনোবিকারের একটা পর্যায়। বেটির মৃত্যুর বর্ণনা আমি মেগানের কাছ থেকে পাবার পর মনে মনে একটা ছবি এঁকে ফেলেছি। এ.বি.সি. এবং বেটি–দুজনে পাশাপাশি বসে আছে। সামনে নীলসমুদ্র। বালিয়াড়ির উপর জলরাশি উপরে পড়ছে। রাতের আকাশ মাথার ওপরে, নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। রাতের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে দুজনেই আনমনা হয়ে উঠেছে। এ.বি.সি.-র ওপর বেটি তার শরীর হেলিয়ে দিয়েছে। বেটির চুল নিয়ে আদর করছে এ.বি.সি.। কি একান্ত সেই ক্ষণ? বেটি আদরে আদরে জর্জরিত, ভালোবাসায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে তার দুটি চোখ। এ.বি.সি.-র হাত ততক্ষণে চলে এসেছে আরো নিচে। তার আঙুল খেলা করে বেড়াচ্ছে বেটির মুখে, নামে, গলায়। খেলতে খেলতে খেলার ছলে সেই আদরভরা হাতখানাই খুলে নিলো তার কোমরের বেল্ট। হাতের মালিক বেটিকে বললো, যদি এই মুহূর্তে তোমাকে খুন করি। বেটি নীরব। চোখ বন্ধ। বেল্টটা জড়িয়ে ধরলো বেটির গলা। বেটি শান্তভাবে বললো, খুন করবে? করো না। আর অপেক্ষা না করে এ.বি.সি. একটু একটু করে টেনে দিলো বেটির গলার বেল্ট।
…এবার স্যার কারমাইকেলের প্রসঙ্গে আসছি। ভারী কোনো অস্ত্র দিয়ে তার মাথা থেতলে দেওয়া হয়েছিল। জেরা-টেরার পর একটা নতুন প্রশ্ন সংযোজিত হলো–বর্ণমালার নিয়ম মেনে খুনী ঠিক এ.বি.সি. করে এগোচ্ছে, তখন সি.-র ঘরে একশো তিপান্ন অথবা পঞ্চান্ন অথবা সাতান্ন নম্বরে থাকা কাস্টন। অতএব আমি প্রায় পনেরো মিনিট ধরে নাজেহাল হয়ে গাইড বুক ঘাঁটলাম। কিন্তু খোঁজাই সার। নম্বরের ব্যাপারে মিলের নাম গন্ধও নেই। এই তফাত কেন? নিয়মনিষ্ঠ ব্যক্তির এমন অনিয়ম হওয়ার তো কথা নয়। তারপরেই এলো চতুর্থ চিঠি। এবারে খুনের জায়গা ডন্ কাস্টার। কিন্তু ভুল হলো একটা জায়গায়। বর্ণমালার চার নম্বর অক্ষরের খুন হওয়ার কথা। কিন্তু পাঁচ নম্বর অক্ষর সেই জায়গায় চলে এলো। অবশেষে বিবেকের দংশনে তাড়িত হয়ে হত্যাকারী স্বয়ং এসে ধরা দিলো। বাকি সমস্যা সমাধানের অবশিষ্ট রইলো আদালতের রায়। আমি কিন্তু এখনও খুশী নই। শুনে অবাক হচ্ছেন তাই তো? কারণ দুঃখ রয়ে গেল একটাই, কেন-র জবাব এখনও আমার অজানা রয়ে গেল। আর একটা ব্যাপার, বেহিলের খুনের ব্যাপারে আসামী যে মিথ্যে উত্তর খাড়া করেছে, সেটা আজও আমার কাছে অন্ধকারের মতো কালো হয়ে আছে।