কয়েকদিনেই কাস্টের চেহারা ভীষণ ভেঙে পড়েছে। বললাম, কি আমাকে চিনতে পারছেন?
কাস্ট আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বললো–না। আমি আমার নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, আপনিই তো আমাকে পরপর চারখানা চিঠি পাঠিয়েছিলেন। তখন তিনি আমাকে গোয়েন্দা হিসাবে চিনতে পারলেন ঠিকই কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে বললেন, আপনাকে আমি কখনো কোনো চিঠি লিখিনি।
–তাহলে কে কিঠিগুলো পাঠালো?
হবে আমার কোনো শত্রু। আমাকে বিপদে ফেলতে চায়, আমাকে হেনস্তা করা তার ইচ্ছা। আমার দুঃখকষ্ট দেখে আনন্দ পাবে বলে একাজ করেছে।…জানেন, আমার বিরুদ্ধে সবাই ষড়যন্ত্র করে, আমাকে ভালো নজরে কেউ দেখে না। তাই পুলিশ কোর্টের কেউ আমায় পছন্দ করে না। আমি যেন ওদের কাছে বিষ।..কিন্তু আমার জীবনের গোড়ার দিকে, যখন আমার মা বেঁচেছিল, তখন মায়ের স্নেহ-মমতায়, আদর-যত্নে, ভালোবাসায় আমার মন কানায় কানায় পূর্ণ ছিল।
আমিও আমার ভালোবাসা শ্রদ্ধা তাকে উজাড় করে দিতাম। আমাকে নিয়ে তার মনে অনেক স্বপ্ন ছিলো। বলতো, আমার একটি আঙুলের ইঙ্গিতে পৃথিবী অচল হয়ে যাবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে লাগলেন মিঃ পোয়ারো, আমার মায়ের কোনো সাধ আমি পূর্ণ করতে পারিনি। তাই বুকভরা হতাশা নিয়ে একদিন তার কাছ থেকে চলে এলাম। পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ মানুষের বাস, তারা যে যার ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখে, কিন্তু কেউ তোয়াক্কা করে না। কেউ সেই স্বপ্ন পূর্ণ করতে পারে না।…আমাকেই দেখুন না, আমার মায়ের স্বপ্ন কি আমি সার্থক করতে পেরেছি…পারিনি। সেই স্কুল জীবন থেকে শুরু করে চাকরি জীবন পর্যন্ত কোনো ক্ষেত্রেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। জানেন, সবাই আমাকে মূর্খ বলতো। পরিচিত গণ্ডীর মধ্যে নিজকে সযত্নে আড়াল করে সেই অন্ধ অহঙ্কারের তাড়নায় সারাটা জীবন বোকার মতোই কেবল ছুটেই মরলাম।.অপদার্থ অপবাদ জীবনে ঘোচাতে পারলাম না।
-আপনি যখন যুদ্ধে গেলেন?
-হ্যাঁ, যুদ্ধ। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। আমাদের তখন একটাই পরিচয়, আমরা সৈন্য। জাত–পাত, মূর্খ-জ্ঞানীর কোনো আলাদা পরিচয় নেই। শত্রু সৈন্যদের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা কি অসহায়!…আমি সেখানে পেলাম বুকভরা আনন্দ।..তারপর সেই গুলি মাথার পেছনে ঢুকে গেলো।..ভয়ঙ্কর জখম। আরো নানারকম রোগে আক্রান্ত হয়ে ওখান থেকে বিদায় নিলাম।… থেকে থেকে মাথার অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতাম।…কি করতাম, না করতাম, কিছু মনে থাকতো না।…অবশেষে মোজা বিক্রি শুরু করলাম। শরীর না চললেও পেট তো মানবে না। তাই ঘুরে ঘুরে মোজা ফেরি করি।
-কোনো কোম্পানি নাকি আপনার নাম কখনও শোনেনি?
–এই কথা বলেছে? সব ব্যাটা শয়তান। সবুর করুন। আমিও মজা দেখিয়ে দেবো। যেদিন কোর্টে মামলা উঠবে, তাদের ছাপানো প্যাডে আমার নাম লেখা চিঠির বোঝা ম্যাজিস্ট্রেটের নাকের ডগায় ছুঁড়ে দেবো। তখন দেখবো ব্যাটারা কিভাবে অস্বীকার করে।
বললাম, চিঠি?
-হ্যাঁ, চাকরিতে যোগ দিতে অনুরোধ করে চিঠি দিয়ে কোন শহরে যেতে হবে, সেসব নির্দেশ দেওয়া চিঠি–সবাইকে দেখিয়ে দেবো। টের পাবে সবাই।
-না, হাতে লেখা হবে কেন? বড় কোম্পানি, সব টাইপ করা চিঠি। তাদের তো টাইপ মেশিনের অভাব নেই।
-আপনার ঘর তল্লাশি করে একটা টাইপ মেশিন পাওয়া গেছে। আমি ইতস্তত করে বললাম।
হতে পারে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কাজের সুবিধার জন্য কোম্পানি মেশিনটা আমাকে ব্যবহার করতে দিয়েছিল। আমি আলমারিতে সেটা রেখে দিয়েছিলাম।
–কিন্তু আমি যদি বলি, আমাকে যে চিঠিগুলো পাঠানো হয়েছিল সেগুলো ঐ টাইপ মেশিনে টাইপ করা হয়েছিল। আপনি কি সেটা উড়িয়ে দেবেন?
অবশ্যই। আমি যেটা করিনি সেই দোষ নিজের ঘাড়ে নেবো কেন? তাছাড়া আপনি কি করে জানলেন, চিঠিগুলো ঐ মেশিনে টাইপ করা হয়েছিল।
–না, অন্য মেশিনে নয়। তাছাড়া আপনার ঘর থেকে বেশ কয়েকখানা এ.বি.সি গাইড পাওয়া গেছে।
–আসল ব্যাপারটা কি জানেন, ওগুলো যে এ.বি.সি, গাইড সেটা আমি নিজেই জানতাম না। পিওন পার্শেলটা দিতে এসেছিল। ভাবলাম, কোনো কোম্পানি হয়তো মোজা পাঠিয়েছে। খুলে তো অবাক। ফেলে না দিয়ে সেগুলো আলমারিতে রেখে দিলাম।
আর ঐ যে টেবিলের ড্রয়ারে রাখা নামের তালিকা। এক-একটি নামের পাশে পেন্সিল দিয়ে মার্ক করা হয়েছে, এর মানে কি?
এটা তো সোজা ব্যাপার। যেসব বাড়িতে ঘুরেছি, সেগুলো পেন্সিল দিয়ে দাগ কেটে রেখেছি।
–আপনার কথা আমি মানতে পারলাম না। যদি বলি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দাগগুলো দিয়েছেন, এক-একটা খুনের পর
না, এসব সাজানো, সব মিথ্যে। আমাকে ফ্যাসাদে ফেলার জন্য এ এক চক্রান্ত। আমি সেদিন রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত ইস্টবোর্নের হোয়াইট ক্রমের বৈঠকখানায় বসে দাবা খেলেছি। …সেদিনর রেজিস্টারে আমার নাম সই করা আছে, তাছাড়া চব্বিশ তারিখ স্পষ্ট করে লেখা আছে।
-আপনি সেদিন দাবা খেলতে বসেছিলেন কেন? অন্য খেলাও তো খেলতে পারতেন। দাবা আপনি ভালো খেলেন বুঝি?
ভালো-মন্দ জানি না। তবে খেলতে বসলে কোনো হুঁশ থাকে না। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে মন সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমনই নেশা। সেদিনের একটা ঘটনার কথা বলি, সেটা ছিল দ্বিতীয় বাজি। চুপচাপ খেলছি। তার আগের বাজিতে আমি জিতেছি। দ্বিতীয় বাজিতে স্ট্রেঞ্চকে প্রায় ঘায়েল করে এনেছি, এমন সময় দর্শকদের মধ্যে একজন আমার হাত টেনে নিয়ে দেখতে শুরু করলো। আমার সম্বন্ধে কয়েকটা প্রশ্ন করলো, কি চাকরি করি, কত আয় ইত্যাদি। শেষে বললো, মরার আগে আমার নাম পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। এক ডাকে সকলে আমাকে চিনবে। আরো বললো, ফাঁসিতেই নাকি আমার মৃত্যু।