আমাদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো–আমি একবার ইস্টবোর্নে যাবো। একাই যাবো। কাজ সেরে ফিরে আসতে প্রায় ঘন্টা দুয়েক সময় লাগবে। আপনারা সবাই এখানে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে হোয়াইট ক্রসে চলে যাবেন। সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন।
আমরা যখন হোয়াইট ক্রস হোটেলে ফিরে এলাম তখন বেলা দুটো বাজে। টেবিলের চারধারে বসলাম। বৈঠক শুরু হলো।
নীরবতা ভঙ্গ করে কথা বলে উঠলো ফ্রাঙ্কলিন–আচ্ছা, সকাল থেকে যে চক্কর মারা হলো, তাতে কি কোনো কাজ হলো?
-না সব বিফলে গেল। এখন আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে। চুপ করে কেবল অপেক্ষা করতে হবে। এখন ওসব কথা বাদ দিন। আসুন, একটা খেলা খেলি।
-খেলা! আমরা সবাই অবাক হয়ে পোয়াটের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
-হা, ছোটোবেলায় অনেকে মিলে আমরা এই খেলাটা খেলতাম। দলে একজন নেতা থাকতো। গোল হয়ে সকলে বসতাম। দলনেতা প্রত্যেকটি ছেলেকে বিভিন্নভাবে তিনটি করে প্রশ্ন করতো। এই খেলায় নিয়ম ছিল, তিনটে প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলেও জবাব দেওয়া চলবে না। প্রথম দুটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে হত, কিন্তু শেষের প্রশ্নের জবাব ইচ্ছা না থাকলেও ভুল বলতে হত। যদি-বা কেউ মনে না থাকার দরুন সঠিক জবাব দিতো তাহলে সে ফল হিসাবে পেত এতবড় এক গোল্লা। অনেকক্ষণ ধরে এই খেলা চলতো। তারপর প্রত্যেক খেলোয়াড়ের নাম যোগ-বিয়োগ করে দেখা হত। সে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেতে তাকে জয়ী বলে ঘোষণা করা হত। এই খেলার নাম কি জানেন? মহাসত্য। তবে আর একটা মজা ছিল। খেলায় যোগ দেওয়ার আগে খেলোয়াড়কে ঈশ্বরের নামে শপথ করতে হত, বিশ্বাস ভঙ্গ করবে না কেউ।
শুরু হলো খেলা। খেলার উদ্বোধন করলো মেগান। সে শপথ করলো, সময় কম, তাই পোয়ারো বললো-এখানে তিনটে প্রশ্ন হবে না। হবে একটা প্রশ্ন। সকলকে ঐ একটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে হবে। এ ব্যাপারে কারো কোনো মন্তব্য থাকলে এ সময়ে বলতে পারেন।
সবাই ঘাড় নেড়ে জানালো, তাদের কারো কিছু বলার নেই।
-তাহলে আমার ইচ্ছা, পোয়ারো বললো, খেলাটা কোনো ছেলেকে দিয়েই শুরু করা হোক। প্রথমে জবাব দেবে ফ্রাঙ্কলিন। পোয়ারো প্রশ্ন করলো–ফ্রাঙ্কলিন, আপনি বলুন, অ্যাসকটের শীতপ্রধান অঞ্চলের মেয়েরা যে ধরনের টুপি পরে আপনি কি দেখেছেন?
–আসলে অ্যাসকটে তো কোনোদিন যাইনি।..তবে শহরের আশেপাশে যে সব মেয়েদের নজরে পড়েছে, তাদের টুপির চেহারা দেখেছি। বলা যায় প্রশংসনীয়, যেন একটা বুড়ি মাথার ওপর উল্টে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঝুড়িটা কপালের ওপর দিয়ে নাক পর্যন্ত নেমে এসেছে। আচমকা নজরে পড়লে মনে হয়, যেন একটা মস্ত টুপি অলস ভঙ্গীতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে।
-এবার মঁসিয়ে ফ্রেসার বলুন, এ বছরের ঠিক কোন সময় আপনি অফিসে ছুটি নিয়েছিলেন?
–আগস্ট মাসের পয়লা থেকে পনেরো তারিখ পর্যন্ত পনেরো দিনের ছুটি নিয়েছিলাম।
এবার থরার দিকে তাকিয়ে পোয়ারো বললো, আচ্ছা মাদমোয়াজেল, স্যার কারমাইকেলের জীবিত অবস্থায় যদি লেডি ক্লার্ক মারা যেতেন তাহলে আপনি তাকে বিয়ে… ।
-থামুন…আর একটা কথাও বলবেন না। উনি ছিলেন আমার কাছে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। দেবতার মতো। ঐরকম ভদ্র, সজ্জন লোকের সম্পর্কে আপনি এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। আপনাকে আগেই জানিয়েছি, উনি আমাকে তার মেয়ের মতো স্নেহ করতেন।
মাদমোয়াজেল বার্নার্ড, মেগানকে প্রশ্ন করলো পোয়ারো, আপনি কি আপনার বোনের হত্যা রহস্যের নিগুঢ় সত্যটি জানতে চান না?
মেগান ইচ্ছার বিরুদ্ধে জবাব দিলো, না, আমি জানতে আগ্রহী নই।
ওর জবাব শুনে ঘরের সকলে হতভম্ব হয়ে গেল।
তারপর মেরির দিকে তাকিয়ে পোয়ারো জিজ্ঞেস করলো, তোমার মন দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারে এতদিনে কি কিছু ঠিক করে উঠতে পারলে?
সে দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে উত্তর দিলো, না, পারিনি।
পোয়ারো চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
–আমাকে বিশেষ কাজে এখুনি বেরোতে হচ্ছে। কে কত নম্বর পেলো, সেটা পরে জানাবো। ভাবছি, আর একবার বেক্সহিলে টহল দিয়ে বাড়ি ফিরবো। আপনারা যে এতক্ষণ বসে আমাকে সহযোগিতা করলেন সেজন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। হেস্টিংস, দেরি কোরো না চলো।
দ্রুত পায়ে পোয়ারোর পিছু পিছু রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম।
প্রশ্ন করলাম–পোয়ারো এই নিয়ে তিনবার তুমি বেক্সহিলে গেলে। কি ব্যাপার বলো তো?
-উঁহু…। দুবার।
–দুবার ঘুরে এসেছে, আবার যাচ্ছে। তাহলে তিনবার হলো না।
-না, এখন বেক্সহিলে যাচ্ছি না। ওখানে আর কাজ নেই। আসলে ওদের কাছ থেকে ঐ অছিলায় বেরিয়ে এলাম। নাও, আর কথা না বাড়িয়ে এগোও। কাস্টের সঙ্গে আলোচনাটা এই বেলা সেরে ফেলতে হবে। তারপর বাকি কাজগুলো সম্পূর্ণ করে পরে তোমার প্রশ্নের জবাব দেবো।
আমাকে অপেক্ষা করতে বলে পোয়ারো চলে গেল কাস্টের সঙ্গে দেখা করতে। ওদের মধ্যে কি কথা হয়েছিল এটা শোনার সৌভাগ্য আমার হয়নি। অবশ্য পোয়ারো ইচ্ছে করলে, তার প্রিয় বন্ধু হেস্টিংসকে সঙ্গে নিতে পারতো। কিন্তু তা করলো না–
কিছুক্ষণ পরে পোয়ারো ফিরে এলো। আলেকজান্ডার বোনাপার্ট কাস্টের সঙ্গে পোয়ারোর কি কথাবার্তা হয়েছে সব কিছু নিখুঁতভাবে আমাকে জানালো, সাক্ষাৎকারের সমস্ত ঘটনা যেন আমার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠলো। আমার মনে আর কোনো দুঃখ রইল না।