তবে, লায়লেন বললো, মিসেস মার্থারির বাড়ির ভাড়াটে মিঃ আলেকজান্ডার বোনাপার্টের কাস্ট-ই এ.বি.সি., এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। মিঃ পোয়ারো, আপনি কি বলেন?
-আমি…আবার…হয়তো হিসেবের গরমিল…এখনো আমার পুরোনো হিসেবের উত্তর পেলাম না। কেবল ঘুরে ফিরে একই প্রশ্ন মনে জাগে–এই খুনের কারণ কি? খুনের মোটিভ-ই বা কি? জবাব এখনও অজানা। তাই হিসেবের ফাঁকটুকু ভরাট করা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
সেদিনের মতো বৈঠক শেষ হলো।
‘এটাকে আবার ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর লেখা বলে মনে করবেন না।‘
কাস্ট ঐখানেই দাঁড়িয়ে পড়লেন। ওখান থেকে দাঁড়িয়ে দূরের দোকানটা দেখা যাচ্ছে। খুব ভালো ভাবেই দেখা যাচ্ছে।..কবে যেন এসেছিলাম, সেই জুন মাসের একুশ তারিখে। এখনও দোকানের সামনে সাইনবোর্ডটা ঝুলছে। দোকানের নাম ঝলমল করে নজরে পড়ছে—
এ. এ্যাম্বার।
আর দোতলার জানলায় ওটা কি ঝুলছে..গরাদে দেখছি একটা কাগজ সুতো দিয়ে বাঁধা…কি যেন লেখা…গোটা গোটা অক্ষরে…নজরে পড়ছে না। চশমাটা বের করে চোখে লাগলেন বাড়ি–ভা-ডা-দে-ও-য়া-হ-ই-বে।
তার মানে বাড়িতে এখন কোনো বাসিন্দা নেই, খালি।
দয়া করে দোকানের সামনে থেকে একটু সরে দাঁড়াবেন।
কথাটা শুনে কাস্ট ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, সবজির দোকানের মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়ালেন।
খানিক বাদেই ওখান থেকে তিনি সরে পড়লেন। হঠাৎ তার দেওয়ালের নিকে নজর পড়লো। বড় বড় হরফে লেখা একটা পোস্টার সাঁটা।
সাবধান।
হয়ত আপনার পাশের মানুষটাই সেই উন্মাদ এ.বি.সি.। এই নরপিশাচ শয়তানের থেকে নিজে বাঁচুন, অপরকে রক্ষা করুন। মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো বলেন…
মঁসিয়ে পোয়ারো…উনি কি এতদিন কোনো সন্দেহ করে উঠতে পারেননি।
আবার কাস্ট পথ ধরে এগোতে লাগলেন। মনে পড়ে গেল সেই কথাটা। কে যেন বলেছিলেন–মানুষ এক অদ্ভুত জীব। কথাটা শুনে আজ আর বিস্মিত হতে হয় না। নিজেই যখন আজব জীব।…আমাকে অনেকে ব্যঙ্গ করতো, তামাশা করতে…আমি গুরুত্ব দিতাম না।
হঠাৎ তার চিন্তার ছেদ পড়লো। কোথায় এলাম…আলো ঝলমল করছে..লোকজন…পুলিশ… সার্জেন্ট…সত্যি, হাসি পাচ্ছে। কিন্তু হাসতে গিয়েও হাসি ঠোঁটে এলো না। চোখের সামনে পৃথিবী দুলে উঠলো। মাথা বনবন করে ঘুরছে। জ্ঞান হারিয়ে তিনি লুটিয়ে পড়লেন উঠোনের কেয়ারি করা ঘাসের ওপর।
তেসরা কি চৌঠা সেপ্টেম্বর হবে। বেলা দশটা নাগাদ ডঃ টম্পসনকে নিয়ে জ্যাপ এসে হাজির হলো। এতদিনে পুলিশ কোর্টের একদফা শুনানি হয়ে গেছে। এরপর সরকার বনাম আলেকজান্ডার বোনাপার্ট কাস্টের মামলার দায়রার সোপাদ হয়েছে। শুনানির দিন পোয়ারো হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লো। ফলে আমরা কেউই কোর্টে হাজির থাকতে পারিনি।
কাগজে মামলার খবর ছাপা হয়েছে।
–আসামীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের এমন ফলাও সুযোগ দেওয়ার কি প্রয়োজন ছিল? আমি বললাম।
পোয়ারো আমার কথা শুনে হেসে উঠলো। সেটা ওদের ব্যাপার, ও নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা করার কোনো দরকার নেই। যদি বিচারে প্রমাণ হয় যে সে প্রকৃতিস্থ নয়, পাগল, তাহলে বেকসুর খালাসের প্রশ্ন আসছে।
-না, তার মধ্যে পাগলামির কোনো লক্ষণ আমি সেদিন দেখিনি। তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তার চাল-চলন কথাবার্তা স্বাভাবিক। আমাদের ডাক্তারি শাস্ত্রে স্বপ্নচারিতা বলে একটা রোগের কথা উল্লেখ আছে। যে লোক এই রোগের কবলে পড়ে সে ঘুমন্ত অবস্থায় যে কাজ করে, তার চেতন মনের সমর্থনে সে সেটা করে থাকে। কাস্ট এর ব্যতিক্রম নয়। সে যে চারটে খুন এ পর্যন্ত করেছে, তার প্রত্যেকটিতে তার চেতন মনের সায় সম্পূর্ণভাবে রয়েছে।
প্রতিটি খুন করার আগে সে পোয়ারোকে চিঠি দিয়ে জানান দিয়েছে। তার মানে খুনটা সেছে পরিকল্পনামতো। আগে থেকেই ভেবে নিচ্ছে। ধরা যেতে পারে শহরে এত লোক থাকতে বেছে বেছে আপনাকে কেন আক্রমণ করছে? সেটা হলো, আসলে আপনার নামের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ, তার আক্রমণ। আপনাকে নিয়ে ওর যত না ভাবনা, তার থেকে বেশি মাথা ব্যথা ছিল এরকুল পোয়ারো নামটাকে নিয়ে। মনোবিজ্ঞানে এই রোগকে বলা হয় মনোবিকল। যারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত, নাম-যশ আছে, তাদের হিংসা করা। লোকের সামনে তাকে ছোটো করে তুলে ধরা…লক্ষ্য করুন, ওর নামের প্রথম দুটো অংশ দুই শ্রেষ্ঠ পুরুষের নামের অংশবিশেষ। শিশু বয়সে ওর ঐ নাম রাখা হয়েছিল। আশা করা হয়েছিলো, বড় হয়ে নামকরা প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি হবে। কিন্তু সেটা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে তার মনে একটা ক্ষোভ বাসা বাঁধলো। বিতৃষ্ণা জাগলো স্বনামধন্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। কিন্তু টমসন, থানায় ভালোমানুষের মতো নিজে আসার কারণটা কি?
-ওটা সাধারণত হয়ে থাকে। অপরাধী মনের চিরন্তন মনস্তত্ত্ব। যাকে বলে বিবেক। পাপ যখন কানায় কানায় ভরে যায় তখন বিবেকের দংশনে নিজেই পাগল হয়ে যায়। অপরাধ স্বীকারের জন্য মন তখন ছটফট করে ওঠে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
এইভাবে কিছুক্ষণ আলোচনা চললো। টমসনের অন্য কাজ পড়ে আছে। তাই সে সেখান থেকে চলে গেল।
আমাকে একা পেয়ে জ্যাপ বললো–আপনার আর মিঃ পোয়ারোর সঙ্গে এ.বি.সি.-র মামলার ব্যাপারে কিছু আলোচনা করতে এলাম, দায়রা কোর্টে ইতিমধ্যে একটা জট পাকিয়ে উঠেছে। এটার জন্য দায়ী ঐ উঠতি বয়সের ব্যারিস্টার লুকাস। কাউকে কিছু না জানিয়ে সে হট করে মস্ত বড় একটা দরখাস্ত জর্জ সাহেবের এজলাসে জমা দিয়েছে আসামী পক্ষের হয়ে সে কথা বলতে চায় এটাই তার ইচ্ছা।