মিঃ জ্যাকবের কাছ থেকে কার্স্টনের ফাইলটা চেয়ে নিয়ে ক্রোম পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে নিজের মনে বললো, হিস নামে একজন তোক সিনেমা হলের সামনে এক অদ্ভুত লোককে দেখেছিল, ছবি দেখে বেরিয়ে সে নাকি আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে কি সব বলছিল। ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে নিলো–যে লোক পরপর চারটে খুনের সময় বাইরে থাকে, তাকে তো সন্দেহ করা যেতেই পারে। ওর ওপর কড়া নজর রাখা প্রয়োজন।
ক্রোম জ্যাকবকে উদ্দেশ্য করে বললো-শুনুন, লোকজন নিয়ে আপনি বরং ক্যামডেনের এই ঠিকানায় চলে যান, আমি স্যার লায়লেনের সঙ্গে কিছু আলোচনা সেরে ওখানে যাচ্ছি।
.
টমকে ইয়ার্ডের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে লিলি বাইরে ফুটপাথে অপেক্ষা করছিল। টম ফিরে এলো তার কাছে। লিলি উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো, সে কার সঙ্গে কথা বলেছে? কি কথা হয়েছে ইত্যাদি।
টম ক্রোমের সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে সব হুবহু বলে গেল।
-তাহলে ওরা আজই ক্যামডেনে আসছে কাস্টের সঙ্গে দেখা করার জন্য?
–সেরকমই বললো।
–তোমরা দেখছি গোবেচারা নিরীহ লোকটিকে তিষ্ঠোতে দেবে না।
বাঃ, তুমি দেখছি খুনীটার হয়ে ওকালতি শুরু করলে। এখন চুপ করো, যখন কাগজে তোমার মার, তোমার আমার ছবি বের হবে তখন তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবো, কেমন। তার আগে তোমার মাকে বলল, আমারে যেন পেট ভরে খাইয়ে দেয়।
হঠাৎ যেন মনে পড়েছে, এমন ভঙ্গিমায় লিলি বললো, এক বান্ধবীকে ফোন করতে হবে। সে একথা বলেই সামনের ডাক্তারখানাতে ঢুকলো ফোন করতে।
.
হাত থেকে রিসিভার নামিয়ে রেখে কাস্ট মিসেস মার্থারির দিকে তাকালেন।
–কোনো খারাপ খবর নাকি? মিসেস মাথারি জানতে চাইলো। ফোনে আপনাকে ডেকে দিতে বললো…আপনাদের তো কোনো ফোন আসে না, গলাটা চেনা লাগলো, মনে হলো লিলির গলা। আচ্ছা মিঃ কাস্ট, মেয়েটি কে?
কাস্ট কি বলবে ভেবে পেল না। আমতা আমতা করে বললো, আমার বোন ফোন করেছিলো। পরশু সকালে ওর একটা ছেলে হয়েছে। পরপর দুটো মেয়ের পর এই ছেলে।
-দারুণ আনন্দের খবর। তাহলে আজ বিকেলে নিশ্চয়ই চায়ের আসর বসছে?
–দুঃখিত, আজ হবে না। আমাকে যেতে হবে বোনের বাড়ি। স্টেশনে থেকে বেশ কিছুটা হাঁটতে হয়। এখনই বেরিয়ে পড়া দরকার। নতুবা রাত হয়ে যাবে। এই বলে কাস্ট দরজার দিকে পা বাড়ালেন।
মিসেস মার্থারি তার পথ রোধ করলো। বাধা দিতে চাইলো।
কাস্ট বললেন-সামনের সপ্তাহে সোমবার বা মঙ্গলবার আবার ফিরে আসব। আর দেরি না করে তিনি বেরিয়ে গেলেন। মিসেস মাথারি বোকার মতো তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।
.
কাস্ট উদ্দেশ্যহীনভাবে পথ চলতে লাগলো। চারদিকে মানুষ গিজ গিজ করছে। ফোনটা পাওয়ার পর থেকে ওর মাথা চক্রাকারে ঘুরছে।
…মিঃ কাস্ট, আমি লিলি বলছি, আমি খবর পেলাম, স্কটলান্ড ইয়ার্ডের এক পুলিশ অফিসার আপনার কাছে যাচ্ছেন। সময় আছে, পালিয়ে যান। পালান আপনি…
লিলি…তোমার হৃদয়ে আমার জন্য এত দয়া! তুমি সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে আজীবন বেঁচে থাকো। তোমার ফুলের মতো কোমল হৃদয়ে দুঃখ যেন আঁচড় বসাতে না পারে।
বিদায় লিলি, বিদায়…।
তোমাদের ভালোবাসা আমি মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত মনে রাখবো। বিদায়…
আবার নিয়মমাফিক বৈঠক বসলো। বৈঠকে পোয়ারো, স্যার লায়লেন, ক্রোম এবং আমি উপস্থিত ছিলাম।
মিঃ পোয়ারো, স্যার লায়লেন বললো, আপনিও তো এই বয়সে একটা খেল দেখিয়ে ছাড়লেন। আপনার সেই মোজার সূত্র ধরে কাস্টন, বেক্সহিল, এ্যান্ডোরভারের মোট তিরিশজন লোকের জবানবন্দী থেকে জানা গেছে ঘটনার দিন ভিন্ন ভিন্ন সময় শহরে, শহতলীর বিভিন্ন জায়গায় এক আধপাগলা বুড়োকে তারা মোজা বিক্রি করতে দেখেছে। তাদের কাছ থেকে লোকটার যে চেহারার বর্ণনা পেলাম তার সঙ্গে ব্ল্যাক সোয়ান হোটেলের মেরি স্ট্রাউডের বর্ণনার হুবহু মিল আছে। এমন কি এই খবর পাওয়া গেছে যে বিভিন্ন ঘটনাস্থলের ধারে-কাছে কোনো হোটেলে সে উঠতো।
…আজ সকালে টম নামের ছেলেটির কাছ থেকে সব শুনে আমরা মিসেস মার্থারির সঙ্গে দেখা করেছিলাম। সে জানিয়েছে, মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে লোকটা সেখান থেকে চলে গেছে। ভাবলাম, ওর ঘরটা একবার দেখে যাই। তাই ছজন গোয়েন্দা নিয়ে আমি ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। চারদিকে সতর্ক নজর রেখে দেখলাম। তেমন কিছু ঘরে নেই। সেলফের দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখি ওপরের তাকে বেশকিছু পিচবোর্ডের বাক্স। আমি বাক্সগুলি খুলে ফেললাম। বেরিয়ে এলো সস্তা দামের কয়েক জোড়া সিল্কের মোজা।
…নিচের তাকে একটা ভারী পার্শেল দেখে হাতে নিলাম। খুলে ফেললাম। আটখানা এ.বি.সি. গাইড বুক যত্ন করে রাখা ছিল। ঘর থেকে আমরা বেরিয়ে এলাম।
হলঘরের আলনায় একটা পুরোনো ওভারকোট ঝুলছিল। আমাদের মধ্যে একজন আলনার হাতল ধরে টান মারলো। ঠুং করে মাটিতে পড়লো একটা ছোরা, দশ ইঞ্চি লম্বা ইস্পাতের তীক্ষ্ণ ধারালো ফলা। ফলাটার দুধারে তখনও রক্তের ছিটে শুকিয়ে আছে। বুঝতে বাকি রইলো না, এই ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুনী তার চতুর্থ খুনটি সম্পন্ন করেছিল।
ক্রোমের কথা শেষ হতে পোয়ারো নিচু স্বরে বললো-ডন কাস্টারে কাজ শেষ করে অস্ত্র টাকে কেন বোকার মতন বয়ে নিয়ে এলো।
–হয়তো ব্ল্যাক সোয়ানের মেরি স্ট্রাউড ভীষণ তাড়া দিয়েছিল। তাই কোথাও ফেলে রেখে আসার সুযোগ পায়নি।