ছবি শেষ হয়েছে। বেরোবার জন্য পা বাড়ালাম। এমন সময় পেছন থেকে চাপা আওয়াজ কানে এলো। জেমসন বলতে থাকে, আমি পায়ে পায়ে সেখানে গেলাম, দেখি একটি লোক চেয়ারের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। তার চারপাশে লোক ভিড় করে আছে। আমি সকলকে সরিয়ে এগিয়ে গিয়ে নোকটার কপালে হাত রাখলাম। একেবারে ঠান্ডা। লোকেরা ঐ লোকটিকে চেয়ারে সোজা করে ঠিক করে বসিয়ে দিলো। ওর এখন হাওয়া প্রয়োজন মনে করে কোটের বোম খুলতে গিয়ে চমকে উঠলাম। বাঁ পকেটের হাত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরে পড়ছে। তার পাশে পড়ে আছে এ.বি.সি. একটি গাইড। ঠিক সেই সময় একজন তোক তারস্বরে চিৎকার করে উঠলো-খু-উ-ন।
–গাইডখানা হাতে নিয়ে দেখেছিলেন?
–না, গাইডে হাত দিইনি।
কর্নেল এন্ডারসন ঘরে এসে ঢুকলো।
এবারেও এ.বি.সি.-র কাছে হার স্বীকার করতে হলো। কিন্তু সবদিকেই তো সতর্ক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। ব্যবস্থায় এতটুকু ফাঁক ছিল না।…কিন্তু খুনটা শেষ পর্যন্ত হয়ে গেল। তবে এবারে ভারী কোনো অস্ত্র দিয়ে আগত করা হয়নি। পেছন দিক থেকে ঘাড় এবং গলার দিকে মাঝখানে ছোরার ফলা ঢুকিয়ে দিয়ে মৃত্যু ঘটানো হয়েছে। লোকটা সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছে।
–নিহত লোকটির নাম-ধাম জানা গেছে? পোয়ারো প্রশ্ন করলো।
–হ্যাঁ, নাম জর্জ আর্লর্সফিল্ড। শহরের উত্তর প্রান্তে ওর একটা সেলুন আছে।
–আ-র্ল-স-ফিল্ড…আশ্চর্য, কেমন গড়বড় ব্যাপার।
-ঠিক তাই। এটাও আমার মনে খচখচ করছে। খুন হবার কথা ডি অক্ষরের নামের লোকের। অথচ মৃত্যু ঘটলো দিয়ে শুরু যে ব্যক্তির পদবী…।
ওসব চিন্তা পরে করা যাবে। ক্রোম বলে উঠলো। তার আগে জবানবন্দীর কাজ শেষ করা যাক।
ঘরে এসে ঢুকলো স্যার রজার ম্যানুয়েল ডাউন্স। শান্ত নিরীহ বেঁটেখাটো চেহারার প্রৌঢ় ভদ্রলোক। জানালো শিক্ষকতা তার পেশা, জাইফিল্ড বয়েজ স্কুলে ইংরাজির শিক্ষক। যা যা দেখেছে, তার বর্ণনা দিতে লাগলো-উঁহু, ভাবা যায় না, আমার পাশে পড়ে আছে সদ্য এক মৃতদেহ। ছবি শেষ হতেই আলো জ্বলে উঠেছিল। তখন আমি কিছু খেয়াল করিনি। লোকটি সামনের চেয়ারে বসেছিল। আমি তার পেছনের আসনে ছিলাম, দেখি চেয়ারে মাথা রেখে লেকাটি বসে আছে। আমি তাকে ডাকলাম। কিন্তু ডাকের কোনো প্রতিক্রিয়া তার মধ্যে লক্ষ্য করলাম না। ভাবলাম, নিশ্চয়ই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অতএব আশেপাশের লোকদের ডাকলাম। অনেকেই সেখানে হাজির হলো। ভিড়ের মধ্যে একজন বললো, উনি নাকি মিলিটারি ডাক্তার। আমাদের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে লোকটাকে তিনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আমরা রাজী হলাম। গায়ে হাত দিয়ে দেখলো, ঠান্ডা হাওয়া-বাতাস লাগার জন্য বাঁ-হাতে তার বুকের বোম খোলার পরে ভেসে উঠলো এক বীভৎস দৃশ্য। রক্ত…আর পাশে পড়ে আছে এ.বি.সি. গাইডটি। আমি চিৎকার করে উঠলাম। খু-উ-উ-ন।
…চিৎকার করেই নিজের ঝামেলা ডেকে এনেছি। আমি প্রেসারের রুগী। চিৎকার, লাফানো, দৌড়-ঝাঁপ সব কিছু বন্ধ। বিকেল পাঁচটা থেকে সোওয়া আটটা পর্যন্ত কেটে গেছে। আমাকে এখন বাড়ি গিয়ে ওষুধ না খেলেই হবে না।
-মৃতলোকটি আপনার থেকে কত দূরে বসেছিলেন?
–প্রায় পাশাপাশি আমরা বসেছিলাম। ওর আসন নম্বর ছিল তিন, আমার ছিল চার নম্বরের চেয়ারটি। কিন্তু আমার ঠিক সামনেই এক লম্বা-চওড়ার ভদ্রমহিলা বসেছিলো। আমার ছবি দেখতে অসুবিধা হচ্ছিল। তাই আমি পাঁচ নম্বরে গিয়ে বসি।
এন্ডারসন বললো–মিঃ ডাউন্স আপনি ভাগ্যবান পুরুষ, নিঃসন্দেহে।
-কেন? একথা বলার কারণ?
–এত বড় বিপদের থেকে রক্ষা পেলেন।
–বিপদ আমার, বিপদ-আপনি কি বলছেন? কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না।
–বুঝবেন কি করে? এ.বি.সি.-র লক্ষ্য যখন স্বয়ং আপনি..
–আমি?
-আপনার পদবীর প্রথম অক্ষর বর্ণমালার চার নম্বরে আছে। আপনিই ছিলেন খুনীর লক্ষ্য। সেইজন্য সে ওখানে গিয়েছিলো। কিন্তু আপনার ভাগ্য সুপ্রসন্ন। না হলে এতক্ষণে…
কথাটা শুনে আতঙ্কিত হয়ে ডাউন্স কাঁপতে লাগলো। আর কোনো কথা না বলে ঘর থেকে চলে গেল।
কনস্টেবল ঘরে এসে জানালো, হোটেল ব্ল্যাক সোয়ান-এর মালিক মিঃ বল এবং একজন মহিলা বিশেষ প্রয়োজনে দেখা করতে চায়।
মিঃ বল এবং মেরি স্ট্রার্ড ঘরে এসে ঢুকলো। মিঃ বল নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললো, –বিশ বছর ধরে আমি হোটেল চালাচ্ছি। আর পাঁচ বছর ধরে মেরি আমার হোটেলে আছে। এরকম অদ্ভুত ঘটনা কখনো দেখিনি বা শুনিনি। মেরি বুদ্ধি করে ভাগ্যিস ঘরে ঢুকে পড়েছিল…
-ঘরে? কোন ঘরে?
দোতলার ষোলো নম্বর ঘরে। আপনারা বরং মেরির মুখ থেকে শুনুন। ও যা যা দেখেছে সব বলতে পারবে।
-স্যার, আমি তখন গরম জল নিয়ে দোতলায় ষোলো নম্বর ঘরে গেছি। মেরি বলতে থাকে। দরজা ভেজানো ছিল, আমি টোকা দিলাম। একবার নয়, দুবার। সাড়া পেলাম না। আমি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়লাম। দেখি উনি বেসিনে নিচু হয়ে হাত ধুচ্ছেন। আমাকে লক্ষ্য করলে বলে উঠলেন, কি চাই? আমি বললাম, আপনি সকালে গরম জল চেয়েছিলেন, তাই নিয়ে এসেছি। উনি বললেন, গরম জল আর লাগবে না। ঠান্ডা জলেই হাত ধুয়ে ফেলেছি। আমি তার কথামতো বেসিনের দিকে তাকালাম। অবাক হয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম–চাপ চাপ রক্ত বেসিনে, তার কোটের হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো, ঐ পর্যন্ত জলে ভেজা। কিন্তু কাটা ছেঁড়া কিছুই দেখলাম না। ঐ সময় ওকে কেমন হিংস্র দেখাচ্ছিল। আমি দেরি না করে পড়িমরি করে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি।