ক্রোম বিদায় নিয়ে চলে গেল। ওর চলে যাওয়ার ভঙ্গি দেখে আমরা হেসে উঠলাম। এমন সময় থরা ঘরে এসে ঢুকলো। মাথায় কালো টুপি, পরনে পা অবধি ঢাকা বর্ষাতি। ভিজে ছাতাটা রেখে বললো, যা শুনলাম সব কি সত্যি?
–কি শুনলেন? কে-ই বা বললো আপনাকে?
মিঃ ক্রোম বললেন। বাড়িতে ঢোকার মুখে তার সঙ্গে দেখা হলো। চিঠিটা সত্যি এসেছে। এবার ঘটনাস্থল কোথায়?
–ডন কাস্টার।
–কবে?
বুধবার, এগারোই সেপ্টেম্বর।
–এখন কি করণীয়?
–আপাতত ভবিষ্যতের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে।
…পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে ঠিক করা হলো, ঘটনার দিন আমরা সবাই ডন কাস্টারে হাজির থাকবো। সন্দেহজনক কিছু নজরে পড়লে প্রথমে স্থানীয় থানায় জানাবো। আমাদের অত্যন্ত সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। যদি দল থেকে ছিটকে যাই তাহলে ঝুঁকি নেবো না। মনের জোর অক্ষুণ্ণ রেখে আমরা সত্যের ও ন্যায়ের পথে এগোবো। তাতে যে যতটুকু জানি
পোয়ারোর কথার মাঝখানে থরা ও ফ্রাঙ্কলিন বলে উঠলোনা না, আমরা তার সম্বন্ধে কিছু জানি না। জানত আমরা তাকে কোনোদিন দেখিইনি বা কেউ কথা বলিনি। বারবার মনে করার চেষ্টা করছি, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
–লাভ হত। যদি না আমরা কেউ সত্য গোপন করতাম। পোয়ারো বলতে থাকে। মিস গ্রে, কারমাইকেলের মৃত্যুর দিন বেলা এগারোটার সময় বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে এক অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সে কথা উনি আমাদের জানাননি।
–এসব কথা আপনি কোথা থেকে শুনলেন! উত্তেজনায় থরা লাফিয়ে উঠলো। পরক্ষণে সে শান্ত হয়ে বললো, আসলে লোকটি যুদ্ধ ফেরত এক ফেরিওয়ালা। চাকরি নেই, তাই রোজগারের ধান্দায় বাড়ি বাড়ি মোজা বিক্রি করে বেড়ায়। আমাকে উঠোনে দেখতে পেয়ে আমাকে ঈশারা করে ডাকে। আমি এগিয়ে যেতেই আমাকে মোজা দেখায় এবং কেনার জন্য খোশামোদ করে। লোকটা নাছোড়বান্দা। দশ মিনিট পর সে বাক্স গুছিয়ে চলে গেল। আমিও তারপর লেডি ক্লার্কের সঙ্গে দেখা করতে চলে যাই।
পোয়ারো নিজের চিন্তার মধ্যে ডুবে গেল। কিছুক্ষণ কাটলো এইভাবে, একসময় আমাকে লক্ষ্য করে বললো, মনে আছে, মিসেস এ্যাম্বারের আলমারি ঘেঁটে অনেক কিছুর সাথে একজোড়া নতুন মোজা পাওয়া গিয়েছিলো। তারপর বেক্সহিল। মাত্র দুদিন আগে মিস মেগান এই ঘরে বলেছিলেন, সদ্য কেনা মোজা হাতে নিয়ে তার মায়ের আকুল কান্নার কথা…কি তাই না মাদমোয়াজেল বার্নার্ড?
-হ্যাঁ, ঠিক তাই।
–আর এক ফেরিওয়ালার কাছ থেকে মোজা জোড়া কিনেছিলেন, তাই না?
–হ্যাঁ।
–তাহলে দেখুন, কি বিচিত্র লোক সেই ফেরিওয়ালা। ঘটনা ঘটার আগে বা পরে তাকে ঠিক ঘটনাস্থলে দেখা যাচ্ছে। মিসেস এ্যাম্বার তাকে দেখেছে, মিসেস ফাউলার তাকে দেখেছে, মিস গ্রে-এবার বলুন মাদমোয়াজেল, তার চেহারাটা কেমন দেখতে ছিল?
-মনে আছে কি? মানে, আট-নদিন তাকে দেখেছি তো…গায়ে একটা পুরানো ওভারকোট ছিল…হাঁটে কুঁজো হয়ে হয়ে তবে অল্প…আর কিছু মনে পড়ছে না, তেমন কোনো তার চেহারার বৈশিষ্ট্য নেই যে মনে থাকবে।
নিশ্চয়ই, মনে রাখার মতো চেহারা হলে আমাদের মধ্যে কারো না কারো চোখে সেই চেহারা ভেসে উঠতো। মিস মাদমোয়াজেল, আপনি তার যে চেহারার বর্ণনা দিলেন, তাতে আমার কাজ হবে। ঐ অপরিচিত লোকটিকে আমি চিনতে পারছি।
‘এটাকে আবার ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর লেখা বলে মনে করবেন না।‘
কাস্ট বসে আছেন স্থির হয়ে, যেন একটা পাথরের মূর্তি। নড়ে না, চড়েও না। কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় সেই বিজ্ঞাপনটা তাকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। মনের গভীরে উথালপাথাল শুরু হয়েছে।
ঘরে এসে ঢুকলো বাড়ির মালিক মার্থারি। কাস্ট তাকে দেখে চমকে উঠলো। ব্রেকফাস্ট যেমন ঠিক তেমন পড়ে আছে। চা জুড়িয়ে জল। মাথারি জানতে চাইলো, তার শরীর ভালো আছে কিনা? কাস্ট তখন উত্তেজনায় কাঁপছে। কোনোরকমে জবাব দিলো–আজ আমি বেলতেন হ্যাঁমে যাবো।
-ভারি সুন্দর জায়গা, নিরিবিলি। ব্রিস্টন হয়ে যেতে হয়। একেবারে জমজমাট, মিসেস মাথারির চোখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। কাস্টের হাত থেকে পড়ে যাওয়া খবরের কাগজটা তুলতে তুলতে বলে উঠলোকাগজ খুললেই কেবল একটাই খবর..এ.বি.সি…খুন…তদন্ত… এবার নাকি খুনটা ডন কাস্টারে হচ্ছে। সত্যি, ওখানকার লোকদের কি অবস্থা, একবার ভেবে দেখুন। যদি আমার নামের প্রথম অক্ষর ডি হত তাহলে আমি তিলমাত্র দেরি না করে বোঁচকা-বুচকি নিয়ে এখান থেকে সরে পড়তাম। কি মিঃ কাস্ট, কিছু বললেন?
-না…কিছু বলিনি…
এবার এগারো তারিখে কাজটা সম্পন্ন হবে। ঐ দিন জমজমাট থাকবে এলাকা। তবে পুলিশ বসে নেই, উঠে পড়ে লেগেছে। …একি আপনার মুখ চোখ অমন দেখতে লাগছে কেন, যেন রক্তশূন্য। শুনুন, আজ আর বেরোবেন না। আমার কথা শুনুন।
দেখুন, আপনার কথা মানা সম্ভব নয়। আগে আমার কাজ, আমি কথা দিয়েছি। কথার খেলাপ করা চলবে না, কাজ শেষ করে তারপর অন্য চিন্তা। শরীর আমার ভালো আছে…কেবল একটু ক্লান্ত লাগছে আর কি।
তিনি তৈরি হয়ে নিলেন পোশাক পরে। স্যুটকেস গুছিয়ে বেরোতে গিয়ে দেখেন মিস লিলি তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
মিঃ কাস্ট, আজ এত তাড়াতাড়ি বেরোচ্ছেন?
জরুরী কাজ পড়ে গেছে…না বেরোলেই নয়।…আচ্ছা, মিস লিলি, আপনার মনে কখনো বিপদের আশঙ্কা জেগেছে? আপনি কি ভাগ্য মানেন?