লিফট থেকে বেরোতেই নজরে পড়লো ডোনাল্ড ফ্রেসার অপেক্ষা করছে। এই সময় ওকে আশা করিনি, তাই আশ্চর্য হলাম। তার চেহারায় একটা বিধ্বস্ত ভাব। মনে হয় গত দুদিন তার ওপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে।
বেশ কিছু কথা হলো।
একসময় আমি জানতে চাইলাম, আপনি কি সরাসরি বেক্সহিল থেকে আসছেন?
-হ্যাঁ।
–মিস হিগলিকে কায়দা করতে পারলেন?
–ও, ঐ কাফের মেয়েটা। না, তার ব্যাপারে মাথা ঘামাবার সুযোগ আমার হয়নি।
–তাহলে আপনি ওখান থেকে চলে এলেন?
–কি জানি, তা বলতে পারবো না।
–এটা কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না। পোয়ারো আপনার মনের খবর সব জানে।
-আমি জানি, পোয়ারো বললো গত আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরে মনের মধ্যে যে কথাটা পুষে রেখেছেন আপনি, কাউকে বলতে পারেননি, সেটা আমাকে জানাতে এসেছেন। আপনার যা বলার আছে নির্ভয়ে বলতে পারেন সঁসিয়ে ফ্রেসার।
–আপনি যদি আমার কথা বিশ্বাস করেন, তাহলে বলতে পারি। আচ্ছা, মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কি স্বপ্ন বিশ্বাস করেন? একটা ভীষণ বাজে স্বপ্ন বীভৎস ভয়ঙ্কর। আমি হয়তো স্বাভাবিক নই। হয়তো শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে যাবো। রাতের পর রাত এক স্বপ্ন আমাকে অস্থির করে তুলেছে। আমি বালিয়াড়িতে বেটির জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু তাকে আমি কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। বেটির বেল্ট আমার হাতে, তাকে সেই বেল্ট ফেরত দিতে হবে। আমি সকলের মুখ পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম, নিখুঁতভাবে দেখলাম, আচমকা তার সাক্ষাৎ পেলাম আমি। সমুদ্রের দিকে মুখ করে বসে আছে। জলের ঢেউ গুনতে গুনতে সে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। আমি তার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম। সে কিছু টের পেল না। অবশেষে আমি তার ঠিক পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনাটা। আমার হাতের বেল্ট তখন তার গলায় জড়িয়ে গেছে। আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে বেল্টটা টানতে লাগলাম। ব্যাস, তার নিষ্প্রাণ দেহটা বালির ওপর লুটিয়ে পড়লো। আমার তখন আনন্দ ধরে না। আমি তাড়াতাড়ি তার দিকে ঝুঁকে পড়লাম। দেখি, ও বেটি নয়, ওর দিদি মেগান।…আমি এ স্বপ্নের মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি না। চোখ বুজলেই সেই দৃশ্য ভেসে উঠছে মনের পর্দায়।
ফ্রেসারকে ক্লান্ত দেখালো। পোয়ারো তার দিকে ব্র্যান্ডির শিশি এগিয়ে দিয়ে কিছুটা গলায় ঢালতে বললো, ও আপত্তি না করে সবটা ব্র্যান্ডি গলাধঃকরণ করলো, শিশিটা পোয়রোর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো–আচ্ছা, এই স্বপ্নের অর্থ কি? আমি কি তাহলে বেটির খুনী?
পোয়ারো জবাব দিতে গিয়ে বাধা পেল। চিঠির বোঝা হাতে নিয়ে ডাকপিওন এসে ঢুকলো।
চিঠির ঠিকানায় চোখ বুলিয়ে আমি সভয়ে চিৎকার করে উঠলাম।
–পোয়ারো এসেছে।
আমরা দুজনে টাইপ করা চিঠিটা সামনে মেলে ধরলাম।
.
কি মশাই, এখনও কি অন্ধকারে অন্ধের মতো হাতড়ে বেড়াবেন, না কি এ পর্ব শেষ করবেন? শেষ না করলেও ক্ষতি নেই, লজ্জাও নেই। চলুন, আমরা এক নতুন জায়গায় নতুনভাবে খেলাটা শুরু করি।
বেচারা পোয়ারো। আপনার দুঃখ দেখে আমার চেঁচিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
আপনি কি শাস্ত্র-টাস্ত্র মানেন? যদি মানে, তাহলে এই সুবাদে একটা উপদেশ দিই। কি যেন কথাটা…উদ্যমেন হি সিদ্ধন্তি। তার মানে উদ্যম থাকলে সব কিছু সফল হয়। অতএব যতদিন বেঁচে আছেন, হাল ছেড়ে না দিয়ে লড়াই করে যান। একদিন না একদিন সুফল পাবেন-ই।
ধরুন না, আমাকে। আমার উদ্যম দেখছেন তো, আপনাকে কেমন একের পর এক বোকা বানাচ্ছি। তবে ভাববেন না, সহজে আমি রণে ভঙ্গ দেবো।
যাক, আসল কথায় আসি, এবার কোথায় খেলাটা হবে বলুন। টিপারারি..? না। ওটা আমার বর্ণমালার কুড়ি নম্বর খুনের পর্যায়ে পড়ে। হিসেবমতো ক্রমিক সংখ্যা অনুযায়ী …চার..পাঁচ… সতেরো…আঠারো..কুড়ি। অতএব মাঝখানে ষোলটা সংখ্যা রেখে আমি কোন সাহসে কুড়ির দিকে এগোই বলুন।
যাক, আপাতত ও কথা স্থগিত থাক। আপাতত আমরা চলুন যাই ডন কাস্টারে। হাতের কাছে চার নম্বর রয়েছে ওটার একটা গতি করে নিই।
ইতি
বশংবদ
এ.বি.সি.
চিঠিটা পড়ে আমি উৎকণ্ঠিত হলাম না। বরং খুশী হলাম। এতদিনের সমস্ত উৎকণ্ঠা চতুর্থ চিঠির কল্যাণে ধুয়ে মুছে গেল। তাই স্বাভাবিক ভাবেই দুশ্চিন্তার পরিবর্তে শান্তি পেলাম, স্বস্তি পেলাম।
ক্রোমকে ফোন করে জানানো হলো। পনেরো মিনিট বাদে সে এসে হাজির হলো। দশ মিনিটের মধ্যে মেগান বার্নাড, ফ্রাঙ্কলিনও এসে গেল। মেগান সোজা বেক্সহিল থেকে আসছে।
পোয়রো চিঠি সম্বন্ধে সব কিছু ক্রোমকে জানালো। ক্রোম চিঠিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। চিঠি সম্পর্কে স্যার লায়নেল কি বলে সেটা পোয়ারোকে জানাতে বললো।
ফ্রাঙ্কলিন তার দিকে তাকিয়ে বললো–চিঠিটা তো পকেটে পুরে নিলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু করবেন কি? এগারোই সেপ্টেম্বর ডন কাস্টারে যে মরশুমের শেষ ঘোড়দৌড়, সেটা কি জানেন? ঐ খেলা উপলক্ষ করে ডান কাস্টারে কত লোক জমা হয় জানেন? সারা ইংল্যান্ড ওখানে গিয়ে ভিড় করে। পায় পঞ্চাশ হাজার। আর যাই হোক, খুনী পাগল হতে পারে, কিন্তু চাল সে ঠিক দেবে।
পোয়ারো বলল–সত্যি, মিঃ ফ্রাঙ্কলিন, আপনাকে প্রশংসা করতে হয়। এমন বিপদের দিনেও আপনার বুদ্ধি লোপ পায়নি।
-না না, এতে প্রশংসা করার কি আছে। কথাটা মনে পড়লো, তাই বললাম। তবে আমার ধারণা, এবারের খুনটা হয়তো রেসের মাঠেই হবে।