–মিস গ্রে এখান থেকে চলে গেল কেন, বলতে পারেন?
-শুরুতে লেডি ক্লার্ক তাকে বেশ ভালো চোখেই দেখতেন। অবশ্য পরে…আমরা অনেকক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। চলুন, ভেতরে চলুন। উনি হয়তো ভাবছেন।
আমরা ঘরে প্রবেশ করলাম। চেয়ারে এক রোগা, বিদীর্ণা, রোগে জর্জরিত মহিলার প্রতিমূর্তি যেন বসে আছে। ক্যাপস্টিক আমাদের সঙ্গে লেটি ক্লার্কের পরিচয় করিয়ে দিলো।
–আসুন, মঁসিয়ে পোয়ারো। শুকনো মুখে ভদ্রমহিলা আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। তারপর বলতে শুরু করলো, এমন ঘটনা ঘটলো যা আমার চিন্তার বাইরে। আমি বহুদিন ধরে রোগশয্যায় পড়ে আছি। সেই হিসেবে আমারই আগে মরে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু…ঈশ্বরের কি নিষ্ঠুর পরিহাস…। আপনাদের সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগছে। আমার শরীরের তো এই হাল। অথচ ঈশ্বর তাকে নিয়ে চলে গেল, রেখে গেল এত বড় বাড়ি, অমন এক অবুঝ ভাই…আমার পক্ষে কি সব কিছু সামলানো সম্ভব। জানেন, ওর স্বভাবটা একেবারে ছোট্ট ছেলের মতো। বয়েসের সাথে স্বভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ওকে যে একটু নজরে রাখবো সে ক্ষমতাটুকুও আমার নেই।
–আপনি ওকে নিয়ে ভাবছেন ঠিকই, কিন্তু আমার নজরে তেমন কিছু পড়লো না। একটু আবেগপ্রবণ এই যা।
-হ্যাঁ, ঐ আবেগটাই যত নষ্টের গোড়া। যাই হোক, কাজের কথায় আসি। আমার স্বামীর মত একজন ভালোমানুষকে কিনা শেষপর্যন্ত একটা বদ্ধ উন্মাদের হাতে মরতে হলো। মাইকেলের জন্য আমি যত না কাতর তার চেয়ে দুঃখ পেয়েছি ঐ পাগলার কথা ভেবে। পাগল কি সাধে হয়েছে। অনেক শোক-তাপের ফল, নিজে দুঃখ হলে একজন লোকের দুঃখ অনুভব করতে পারা যায়। যদি একবার তাকে দেখতে পেতাম…আচ্ছা, আপনাদের নাকি ধারণা, লোকটা ট্যুরিস্টদের ভিড়ে মিশে আছে। কিন্তু আমাদের বাড়ির এ পাশটায় তো খুব বেশি ট্যুরিস্ট আসে না। খুন করতে হলে খুনীকে অবশ্যই আমাদের বাড়ির ধারে-কাছে একবার আসতেই হবে।
–কিন্তু ম্যাডাম, তিরিশে আগস্ট কাউকে আপনার বাড়ির ধারে-কাছে দেখা যায়নি।
–কথাটা কার থেকে শুনেছেন? মিস গ্রে কি বলেছে? ওরা কথা একেবারে বিশ্বাস করবেন না। ও একনম্বরের শয়তানি, মিথ্যেবাদী। এই কারণে ওকে আমি মোটেও পছন্দ করতাম না। আমার দুচোখের বিষ। কি ন্যাকা ন্যাকা কথা, আমার কেউ নেই। ছোটোবেলা থেকে লোকের লাথি–ঝাটা খেয়ে বড় হয়েছি। তাতে কি হয়েছে বলুন? তোর ভাগ্যে নেই তাই পাসনি। আমার কপাল ভালো, তাই আমি সব পেয়েছি। অত কথা কিসের বাবা। এ বাড়ির দুই নবাব পুত্রের মধ্যে একজন নিয়ে এলো জামা, আবার অন্য জন নিয়ে হাজির হলো নকল মুক্তোর হার। বড়ভাই তো ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ছোটো ভাই ভাবে গদগদ হয়ে দশ পাউন্ড মাইনে বাড়িয়ে দিলো। এসব আমি বরদাস্ত করতে পারি না। তাই গত সোমবার তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলাম, এখান থেকে তুমি চলে যাও। নিজের আস্তানা নিজে খুঁজে নাও। কথা না বলে সুড়সুড় করে ঘর থেকে সে চলে গেল। তারপরেই ফ্রাঙ্কলিন আমার কাছে এসে হাজির হলো। ও চলে গেলে না কি কথা বলার সঙ্গীর অভাব হবে। তারপর বললো, ওকে তিনমাসের মাইনে অগ্রিম দিয়ে দাও, তাই-ই সই। কিন্তু ওর চেহারা আমি এই বাড়ির ধারে-কাছে দেখতে চাই না। আমি অসুস্থ তাই আমাকে সকলে সহানুভূতির চোখে দেখে। আমি ঝোঁকের মাথায় যা বলি, সেটা ওরা শুনে নিতে বাধ্য হয়। ফ্রাঙ্কলিনও কোনো আপত্তি করলো না।
লেডি ক্লার্ক একটানা বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর হাঁফাতে লাগলো। নার্স বললো–আপনি বরং একটু শুয়ে বিশ্রাম নিয়ে নিন।
-থাক, আর সোহাগ দেখাতে হবে না। তোমাকেও আমি হাড়ে হাড়ে চিনেছি। ঐ শয়তানির সঙ্গে তোমারও কম দরদ ছিল না।
–আপনি মিস গ্রে-কে মিথ্যাবাদী বললেন কেন? পোয়ারো প্রসঙ্গ পাল্টে প্রশ্ন করলো।
–মিথ্যেবাদী নয়তো কি। আপনাকে বলেছে বাড়ির আশেপাশে কোনো উটকো লোককে সে দেখেনি। অথচ আমি জানালার সামনে চেয়ারে বসে সব কিছু লক্ষ্য করেছিলাম। একজন অচেনা লোকের সঙ্গে সে কথা বলছে। সে দাঁড়িয়ে ছিল উঠানে। আর লোকটা ফটকের বাইরে ছিল। প্রায় এগারোটা হবে। লোকটির চেহারা সাধারণ। লম্বা, রোগা, নোংরা পোশাক পরনে-ব্যস। এইটুকু মানে…মি. পোয়ারো, আমার শরীর ভীষণ খারাপ লাগছে, আপনারা এখন আসুন। নার্স…নার্স।
ইচ্ছা না থাকলেও আমাদের বাধ্য হয়ে ঐ ঘর ত্যাগ করতে হলো।
–এতক্ষণে মিস গ্রে আর ঐ লোকটার গল্প শোনা গেল। আমি বললাম, মিস গ্রে এমন একটা খবর কেন চেপে গেল?
–এই কেন-র জবাব আমাকে এখন আবিষ্কার করতে হবে। সময় ও সুযোগ হলে তাকেই একদিন প্রশ্ন করবো।
আশ্চর্য, এমন সুন্দরী শিক্ষিত মহিলার সঙ্গে একটা পাগলের যোগসাজস, এ কল্পনা করা যায় না। সে সুন্দরী বলেই সকলে অপমান করার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে।
-না হেস্টিংস, তোমার কথায় আমি সায় দিতে পারলাম না। সবাই আদাজল খেয়ে লেগেছে, কিন্তু স্যার কারমাইকেল, ফ্রাঙ্কলিন, নার্স ক্যাপস্টিক, এঁরা?
-লেডি ক্লার্কের নাম তো বললেন না?
-বললাম তো। তোমাকে কেবল তিনের সঙ্গে একের ফারাকটা বুঝিয়ে দিলাম।
হোয়াইট হ্যাভেনে ঢুকতেই রিসেপশনিস্ট জানালো, অনেকক্ষণ ধরে এক ভদ্রলোক পোয়ারোর সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছে। সে তার ফ্ল্যাটের সামনে পায়চারি করছে, খানিক আগে এক বেয়ারা দেখে এসেছে।