নীরবতায় ঘর ভরে গেল। খানিক বাদে স্তব্ধতা ভঙ্গ করে থরা। বলল, এখন আমরা কি করবো?
–আপাতত কিছু না, ফ্রাঙ্কলিন বললো এখন আমাদের পাঁচজনকে সবসময় সজাগ হয়ে থাকতে হবে। নিয়মিত মঁসিয়ে পোয়ারোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখবো। আর চার নম্বর খুনের ঘন্টা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাবো। মঁসিয়ে পোয়ারো, তাই তো?
-হ্যাঁ, তাই। তবে এ ব্যাপারে আমার দু-একটা কথা আছে। প্রথমে কাফের মিলি হিগলিকে কিছু প্রশ্ন করা প্রয়োজন। কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে তার পেট থেকে গোপন তথ্য টেনে বের করতে হবে। এই কাজের দায়িত্ব আমি মাদমোয়াজেল বার্নার্ড ও মঁসিয়ে ফ্রেসারের ওপর দিতে চাই। এক্ষেত্রে মিস মেগান, আপনার কাজ হবে, মেয়েটির সঙ্গে যে-কোনো ভাবে ঝগড়া সৃষ্টি করা। আপনি বলবেন, সে আপনার বোনকে দুচোখে দেখতে পারতো না, সেটা সে জানিয়েছে। এ প্রসেঙ্গ বেটি অনেক কথা আপনাকে জানিয়েছে, বলবেন। আর মঁসিয়ে ফ্রেসার, আপনি মেয়েটির সঙ্গে মিথ্যে প্রেম শুরু করুন।
–আমি যদি একবার মেয়েটির খুব কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি
ফ্রাঙ্কলিনকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে থরা চড়া গলায় বলে উঠলো-ওসব নিয়ে তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না। তোমার জন্য অন্য কাজ আছে।
–নিশ্চয়ই, পোয়ারো মাথা নেড়ে বললো, তাছাড়া আপনার খুব কাছে যখন ও আছে। পোয়ারো থরাকে ইঙ্গিত করলো।
ধরা দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বললো, না। আপনি হয়তো জানেন না, আমি ও বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছি। ও বাড়িতে থাকা আমার সম্ভব নয়। কয়েকদিনের মধ্যে পাকাপাকিভাবে লন্ডনে চলে যাব।
–লেডি ক্লার্ক বর্তমানে কেমন আছেন?
–একেবারেই ভালো নয়। থরার পরিবর্তে ফ্রাঙ্কলিন জবাব দিলো। কালকেও তিনি আমাকে বলেছিলেন, যেন আপনাকে আমি অনুরোধ করে বলি ওঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে। যদি দয়া করে–
–অবশ্যই। ওঁকে বলবেন, কাল অথবা পরশু নাগাদ আমি ওঁর কাছে যাবো।
–আমি কি করবো, সেটা তো বললেন না। মেরি বলে উঠলো।
-আছে। তোমার একটা সুন্দর কাজ আছে। তুমি এ্যান্ডোভারে যাবে। সেখানকার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোনো। তাদের মনের সঙ্গে একেবারে মিশে যাবে। তারা দিন-রাত রাস্তায় খেলা করে। অতএব তাদের চোখে কিছু পড়া অস্বাভাবিক নয়।
ফ্রাঙ্কলিন কিছু বলার আগে সে নিজেই বলে উঠলো–খবরের কাগজে বরং একটা বিজ্ঞাপন দিই। ঠিক এইরকম গোছের–এ. বি. সি. হুঁশিয়ার। তোমার পরিচয় আমার আর অজানা নেই। নগদ একশো পাউন্ডের বিনিময়ে আমি মুখ বন্ধ রাখতে রাজি। ইতি–ডিই. এফ.। কি, ভালো হবে না?
–ভালো হবে। একবার চেষ্টা করে দেখতে তো দোষ নেই।
ফ্রাঙ্কলিন বললো–সকলের সুবিধার জন্য সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হলো। আমি পড়ছি, আপনারা শুনুন।(১) মিলি হিগলির সঙ্গে মিস বার্নার্ডের কথোপকথন। (২) মিঃ ফ্রেসারের সঙ্গে মিলি হিগলির প্রেম প্রেম খেলা।(৩) এ্যান্ডোভারের ছোটো ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিস মেরি ড্রেয়ারের বন্ধুত্ব করা (৪) বিজ্ঞাপন।
এরপর সবাই যে যার বিদায় নিলো।
আমি পোয়ারোকে প্রশ্ন করলাম, এসব আলোচনা থেকে তুমি কি বুঝলে?
-বুঝলাম, হাজার কষ্ট-দুঃখের মধ্যেও এক বিন্দুসুখ থাকে। হেস্টিংস তোমার সামনে কেমন সুন্দর একটা নাটক হয়ে গেল, তুমি সেটা লক্ষ্য করলে না। যখন ফ্রাঙ্কলিন মিলি হিগলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিনয় করার কথা জানালো তখন মিস গ্রে কেমন ক্ষেপে গিয়ে প্রতিবাদ করে উঠলো।
এইসময় আবার মিস গ্রে ঘরে এসে ঢুকলোকয়েকটা দরকারি কথা ছিল, সেগুলো না বলে ফিরতে পারছিলাম না। তাই আবার চলে এলাম, আপনাকে কিছুক্ষণ আগে জানিয়েছি এখানকার চাকরি ছেড়ে দিয়ে লন্ডনে চলে যাচ্ছি। সেটা কিন্তু স্বেচ্ছায় নয়। স্যার কারমাইকেলের মৃত্যুর। পর লেডি ক্লার্ক এমন ব্যবহার শুরু করেছেন যে সেখানে আমার টিকে থাকা সম্ভব নয়। তিনি আমাকে পছন্দ করেন না, সন্দেহ করেন। কথা শেষ করে সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
জানো হেস্টিংস, পোয়ারো বলতে থাকে, মিস গ্রে যেমন বুদ্ধিমতী তেমন সাহসী। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতন। আচ্ছা, তুমি কি বলতে পারবে, ওর পরনে কি ধরনের পোশাক ছিল?
এমন এলোমেলো প্রশ্ন করছো কেন? তোমার ব্যাপার কি পোয়ারো?
ব্যাপার গুরুতর ভায়া। বৈঠকের আলোচনা চলাকালীন এক ফাঁকে একটা অদ্ভুত কথাটা শুনলাম। এই কাজটা আগে বোধহয় শুনেছি বা নোট বইতে লিখে রেখেছি। কিন্তু কি যে সেই কথাটা
-তুমি কি কথাটা কার্স্টনে শুনেছো
-না, কার্স্টনে নয়। বেক্সহিলে বা এ্যান্ডেভারে হতে পারে। কি জানি। যাই হোক, মিস গ্রে-র আসল গুণটা কিন্তু তার সব গুণকে ছাপিয়ে গেছে। চেহারার লাবণ্য দেখেছো…যেন স্বর্গের দেবী…অথবা….
আমরা নিরালায় পৌঁছালাম। সেখানে গিয়ে মনটা উদাস হয়ে গেল। ডেভরিন ঘরের সামনে দাঁড়াতে এক সুস্থ মোটাসোটা চেহারার নার্স উঁকি মারলো। সে তার পরিচয় দিলো। নাম জানালো ক্যাপস্টিক। লেডি ক্লার্ককে দেখোশোনা করার ভার তার ওপর দেওয়া আছে। সে বললো–আমি জানি আপনারা আসবেন। মিঃ ফ্রাঙ্কলিন আগেই বলে রেখেছিলেন।
-উনি এখন কেমন আছেন?
–কিছুটা ভালো। মনে হয় ডাঃ মেগানের ওষুধ কিছুটা কাজ করেছে।
–উনি কি খবরটা শুনে ভীষণ ভেঙে পড়েছেন?
-না, উনি ভেঙে পড়েননি। কাতর হওয়া বা মুষড়ে পরার জন্য যে বোধ দরকার সেটা ওঁর মধ্যে নেই। অতএব তিনি মনের দিক থেকে স্বাভাবিক আছেন। এত ওষুধে যে-কোনো সুস্থ স্বাভাবিক লোকও বোধশক্তি হারিয়ে ফেলে। তবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা ছিল নিখাদ। স্ত্রীকে সুস্থ করে তোলার জন্য তিনি সবরকম চেষ্টা করেছেন। এখানে কাজ করতে এসে প্রথম প্রথম আমি রীতিমতো ঘাবড়ে যেতাম তার ব্যবহার দেখে, তবে বছরের পর বছর থাকতে থাকতে সব চোখে সয়ে গেছে। তাছাড়া স্যার কারমাইকেল একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এক বিরাট সংগ্রহশালা তৈরি করেছিলেন। দিনের অনেকটা সময় তিনি সেখানে কাটাতেন। কেনাকাটার জন্য মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক যেতেন। মিস গ্রে-কেজিনিসপত্র আনার জন্য ফর্দ করতে সাহায্য করতেন, এইসব।