-তাই নাকি? দেশ-বিদেশ গেছেন! চীনে গিয়েছিলেন আপনি?
–হ্যাঁ, চীনে তিন বছরের কাছাকাছি কাটিয়েছি।
আরো কিছু কর্থাবার্তার পর ফ্রাঙ্কলিন চলে গেল।
প্রথমে বৈঠক বসলো সোমবার।
গোল টেবিলের বিশেষ লোকটি হলো পোয়ারো। সকলে তার চার পাশে বসেছে। একটু দূরে সকালের কাগজ হাতে নিয়ে আমি বসে আছি। কিন্তু কান আমার সজাগ।
–এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বৈঠক। পোয়ারো বললো, এর সঙ্গে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড বা পুলিশের কোনো ভূমিকা নেই। ইতিমধ্যে যারা খুন হয়েছে তারা কেউই একে অন্যের আত্মীয় বা বন্ধু নয়। এমন কি তারা সমগোত্রীয় নয়। তবে দুটি ঘটনার তিনটি খুনের মধ্যে আমি একটা যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছি। তা হলো তিনটি হত্যাকাণ্ডের অপরাধী একজন লোক এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে সে নিজে উপস্থিত থেকেছে। তাহলে দ্বিতীয় সূত্র লক্ষ্য করলে বলা যায়, ঐ ব্যক্তিটিকে কেউ না কেউ দেখে থাকবে। হয়তো আপনাদের মধ্যে এমন কেউ আছেন যারা তাকে দেখেছেন, বা তার চালচলনে কোনো বৈশিষ্ট্য আপনাদের মনে রেখাপাত করেছে। তবে খুনী পরিকল্পনামাফিক সুস্থ মস্তিষ্কে একের পর এক খুন করেছে। নিহত ব্যক্তিদের সম্বন্ধে খবরাখবর তাকে আগে সংগ্রহ করতে হয়েছে। তথ্য সংগ্রহের জন্য সে নিশ্চিয়ই পরে পরে ঐসব ঘটনাস্থলে এসে থাকবে। তাহলে সে কি একবারের জন্যেও খুনীর আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে না? নিশ্চয় করেছে। আপনাদের স্মৃতির মণিকোঠায় তার কোনো আবছা ছাপ রয়ে গেছে। আজ আমরা অতীতের দিনগুলো স্মরণ করবে, তাকে চেনার চেষ্টা করবো এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই চেষ্টা বিফল হবে না।
কিন্তু, ফ্রাঙ্কলিন বললো, আলোচনার একটা কেন্দ্রবিন্দু তো থাকা প্রয়োজন। এখানে সেটা কি হবে?
-এখানে গদ বাঁধা কোনো প্রশ্ন করা হবে না। বরং এমন অনেক প্রশ্ন করা হবে যেগুলো অযৌক্তিক, অকেজো, যেমন আপনাকে দিয়েই শুরু করা যাক। আপনার দাদা যেদিন খুন হলেন সেদিন রাতে ঘুমোত যাওয়ার আগে আপনি কি কি করেছিলেন?
–বিশেষ কিছু নয়। অন্য দিন যা করি, সেদিনও তাই করেছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়েছিলাম নৌকো নিয়ে। দুপুরে বাড়ি ফিরি। স্নান খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিই। তারপর কিছু ব্যক্তিগত চিঠি নিয়ে বসি। বিকেলে শেষ ডাক না পাওয়ার দরুণ কেইন্টন পর্যন্ত দৌড়নো। সেখানকার বড় পোস্টাফিসে চিঠির বোঝা খালাস করে বাড়ি ফিরে আসি। তারপর রাতের খাবার খাওয়া, শেষে ঘুম। ঘুমিয়ে পড়তাম সেদিনও। কিন্তু থানা থেকে ফোন এসে
–ঠিক আছে, এই পর্যন্ত। আচ্ছা, আপনি নৌকা বাইতে যাওয়ার সময় এমন কাউকে দেখেছেন, যার কথা আজও আপনার বিশেষভাবে মনে পড়ে।
–এক মোটাসোটা মহিলাকে দেখেছিলাম।
–আর যখন বিকেলে চিঠি পোস্ট করতে গেলেন?
-তখন…তখন হা মনে পড়েছে একটা মেয়ে। মেয়েটা আর একটু হলে আমাকে সাইকেলের ধাক্কা লাগিয়ে দিতো। আমি আনমনা ছিলাম না, তাই রক্ষে।
-এবার মাদমোয়াজেল গ্রে, আপনি সেদিন কি কি করেছিলেন?
–নিত্যদিনের মতো ব্রেকফাস্ট সেরে স্যার কারমাইকেলের চিঠির বোঝা নিয়ে বসেছি। কাজ যখন শেষ করে উঠলাম তখন বেলা বারোটা। তারপর স্নান সেরে খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে বসলাম চিঠি লিখতে। দুই বান্ধবীকে চিঠি লেখা শেষ করে কিছু সেলাই ফেঁড়াই করেছিলাম। দেখতে দেখতে কেটে গেল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
-বোনের সঙ্গে শেষ কবে আপনার দেখা হয়েছিল?
ঘটনার পনেরো দিন আগে।
–কি কথা হয়েছিল?
-মামুলি কয়েকটি কথা! টাকাপয়সার টানাটানি যাচ্ছে। মিলি হিগলিকে সে মোটেও পছন্দ করে না। মিস মেরিয়ান মাইনে বাড়াতে মোটেও রাজী নন, এই ধরনের আর কি।
এবার পোয়ারো ফ্রেসারের দিকে তাকিয়ে বললো–আপনি তো কাফের আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করছিলেন যেদিন মিস বার্নার্ড খুন হয়, তাই না?
-হ্যাঁ।
–বিশেষ কাউকে দেখেছিলেন?
–না।
–আচ্ছা মেরি, তোমার স্বামী তো তোমাকে প্রায় রোজই চিঠি লিখতেন?
–হ্যাঁ।
–শেষ চিঠি কবে দিয়েছিলেন?
–ঘটনার তিনদিন আগে লিখেছিলেন?
–কি হলো, চুপ করলে কেন? কি লিখেছিলেন?
-উনি বলেছিলেন, আমি যেন বুধবার আমার নিয়োগকর্তার কাছ থেকে ছুটি করিয়ে রাখি। কারণ ঐ দিন ছিল আমার জন্মদিন। সকাল সাতটার মধ্যে আমাকে এ্যান্ডোভারে চলে যেতে বলেছিলেন, উনিও সেদিন দোকান বন্ধ রাখবেন। আমরা সারাদিন হৈ হৈ করে বেড়াবো, সিনেমা দেখবো, হোটেলে খাবো। তিনি আমাকে একটা জামা কিনে…সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
ফ্রাঙ্কলিন মিসেস এ্যাম্বারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বললো, একদিনের একটা ঘটনার কথা শুনুন। আমি ফুটপাথ ধরে আপনমনে হাঁটছি। এমন সময় শোরগোল কানে এলো। দেখি একটা মেয়ে গাড়ি চাপা পড়েছে। তার মাথার ওপর দিয়ে গাড়ির পেছনের চাকাটা সম্পূর্ণভাবে চলে গেছে। সে তার মায়ের সঙ্গে বেরিয়েছিল। সেদিন তার জন্মদিন ছিল। নতুন একজোড়া জুতো তার মা তাকে কিনে দিয়েছিলো। সেই জুতো জোড়া হাতে নিয়ে মা কান্নায় ভেঙে পড়লো। এই জুতো জোড়া পরেই তার মেয়েটির মৃত্যু হলো বলে তার মায়ের ধারণা।
এইসময় মেগান বলে উঠলো, আমাদের বাড়িতেও এরকম একটা ঘটনা ঘটে গেছে। বেটি যেদিন মারা যায় তার আগের দিন মা তার জন্যে এক জোড়া জুতো কিনে এনেছিল। বেটির আর সেটা পরা হয়নি। ঐ জুতো জোড়া নিয়ে মা কেবল কাঁদে।