হাসতে হাসতে কাস্টের যেন খেয়াল হল, এবার হাসি থামিয়ে বললেন–মানে…বুঝলেন কিনা…যুদ্ধে গিয়ে মাথাটা কেমন যেন বিগড়ে গেছে। মাঝে মাঝে কি যে হয়। চিন চিন করে থেকে থেকে মাথার যন্ত্রণা হয়। এমন অবস্থা হয় তখন কি যে করবো ভেবে পাই না..বুঝতে পারি না… কেমন যেন ঝোঁকের মাথায়..মানে, শরীর স্বাস্থ্য আমার তেমন সুবিধের নয়।
যুবকটি উঠে দাঁড়ালো, হাতের সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো–এখন চলি, এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতে হবে। পরে আবার আমাদের দেখা হবে।
কাস্ট নির্বিকার নিস্পৃহ চিত্তে একইভাবে বেঞ্চির ওপর বসে রইলেন।
সামনের চওড়া রাস্তা দিয়ে কত মানুষের যাতায়াত। মানুষ…কথা…পায়ের আওয়াজ…কথা…।
–বেক্সহিলের পর খুনীর কার্স্টনে পায়ের ধুলো পড়েছে।
–আমি তো শুনলাম, সমুদ্রের ধারে বালির ওপর মুখ থুবড়ে…
–বলো কি! আমি আর তুমি, সবে আমরা গতকাল বাঁকের মুখে দোকানটায় বসে চা খেলাম…
–খুনী ধরা পড়বেই..হ্যাঁ, আলবাত ধরা পড়বে..ইয়ার্ডের লোকজন…
–বাছাধন, কুকর্ম করে কতদিন আর লুকিয়ে দিন কাটাবে। একদিন না একদিন…
–হয়তো লোকটা এই শহরেই ঘুর ঘুর করছে…হয়তো আমাদের কাছাকাছি কোথাও আছে…আমাদের সঙ্গে ভিড়ের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে ফেলেছে…
কাস্ট ধীরে ধীরে বেঞ্চি থেকে উঠে পড়লেন। তিনি নিজের মনে রাস্তা বরাবর হেঁটে এলেন চৌমাথায়। চায়ের দোকানে ঢুকে এক কোণে বসলেন, হাতে চায়ের কাপ।
..কি করে যে অতসব অদ্ভুত খবর মানুষ পাচ্ছে ভেবে পাই না। তবে হ্যাঁ, এই অজস্র প্রহসনের মধ্যে আশার যেটুকু হলো-বেটি বার্নার্ড এবং কারমাইকেল ক্লার্কের নামের সঙ্গে এ্যান্ডোভারের সেই অখ্যাত অনামী সত্তর বছরের বুড়ি এলিন এ্যাম্বারের নামটাও এতদিন পর যুক্ত হলো, আমরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
স্যার ক্লার্কের মৃত্যুর চারদিন পর পার্লামেন্টের এক বিশেষ অধিবেশনের তর্ক-বিতর্ক ডেইলি ফ্লিকার-এর পৃষ্ঠায় বড় বড় হরফে ছাপা হলো সংবাদ শিরোনামে
রহস্য সমাধানের মঞ্চে অবশেষে এরকুল পোয়ারোর পদার্পণ। প্রথম দিনের তদন্তের ফলে রহস্য আশু মীমাংসার পথে।
পৃষ্ঠার এককোণে আরেকটি সংবাদ শিরোনাম নজরে পড়লো।
আমাদের বিশেষ প্রতিনিধির সহিত পোয়ারোর বিশিষ্ট সুহৃৎ ক্যাপ্টেন হেস্টিংসের নিভৃত সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবৃতি
আমি পোয়ারোকে বললাম, খবরের কাগজের প্রতিনিধি দূরে থাক, এক্স, ওয়াই কারো সঙ্গেই আমার এ ব্যাপারে কোনো কথা হয়নি।
–জানি। তিলকে তাল করা ওদের স্বভাব, পোয়ারো বললো।
–কিন্তু, কিন্তু…।
–আর কিন্তু কিন্তু কোরো না, ওসব ভুলে যাও। দিনের পর দিন যদি খবর ওভাবে ছাপা হয় তাহলে আমাদের লাভ হবে। ক্ষতি হবে না।
–একথা বলছো কেন?
কারণ কাগজওয়ালারা জানে, যে এই কেসের তদন্তের ভার আমার ওপর দেওয়া হয়েছে।
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে আগত লোকেদের সঙ্গে ক্রোম কথা বলে জেনেছে তা দিয়ে কেবল কাগজের পর কাগজ লেখা হলো ঠিকই, কিন্তু কোনো কাজে লাগলো না।
পোয়ারো কিন্তু আর মুখ খুললো না। কিছু জানতে চাইলে কেবল এই বলে, এ বয়সে ছুটোছুটি আর সহ্য হয় না। পুলিশ যা করার তা তো করছে। অবশ্য তুমি ভাবছো আমি চুপ করে কেবল ঘরে বসে আছি। তবে বন্ধু, তুমি কি জানো না যে আমার পা কাজ করে না, মাথা কাজ করে। আমার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলি এখন সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে আমি খুনীর ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। খুনীর মনের গোপন কথাটুকু উদ্ধারের চেষ্টা করছি মাত্র।
–মানে উন্মাদের মনস্তত্ত্ব?
–কথাটা শুনতে সহজ ও ছোটো। কিন্তু কাজটা কঠিন। খুনীর আসল রূপ কি? বাইরে থেকে আমরা তাকে যেমন ভাবছি, সেরকম না অন্য কিছু? তবে হয়তো ধীরে ধীরে তার স্বরূপ আমাদের কাছে ধরা পড়েছে। এ্যান্ডোভারের খুনের পর যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল বেটি বার্নার্ড পরে সে জায়গা পূরণ করে দিলো অনেকটা। আর স্যার কারমাইকেলের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সেই খালি জায়গা আরো বেশ কিছুটা পূরণ হলো। তার মুখোশ আমার সামনে একটু একটু করে খুলে যাচ্ছে। আসলে মুখ ঢাকতে সে মুখোশ ব্যবহার না করে করছে মন, পরবর্তী খুন না হওয়া পর্যন্ত
–পোয়ারো, তুমি কি বলছো!
-কেন? অন্যায় কিছু বলেছি? তা তো নয়। খুন আর একটা হবেই। আমরা কোনোভাবেই সে খুন আটকাতে পারবো না। অবশ্য এই চতুর্থ খুনটি আমাদের রহস্যে যথেষ্ঠ আলোকপাত করবে। একটা না একটা সূত্র রেখে যাবে। ঐ সূত্র ধরেই আমরা তাকে একদিন না একদিন ধরবো।
-কে সেই পাগল?
–উত্তর জানা নেই। তার নাম বা ঠিকানা জানার কোনো উৎসাহ আমার নেই। কেবল আমি তার মনের খোঁজ পাওয়ার জন্য উতলা হয়ে আছি। আমি ফাঁদ পেতেই রেখেছি। কেবল সেটা পড়ার অপেক্ষায়। তারপরেই সুতো ধরে টান।
তার মানে তোমার সুতোয় টান পড়তে না পড়তে আরো কয়েকজন নিরীহ মানুষের মৃত্যু হবে, তাই না?
-এর মধ্যে মাত্র তিনজন তো মারা গেল। অথচ…আচ্ছা, তাড়াতাড়ি উত্তর দাও তো, গাড়ি চাপা পড়ে সপ্তাহে যদি একশো চল্লিশ জন নিহত হয় তাহলে দুমাসে কত সংখ্যায় দাঁড়াবে?
–পোয়ারো, এটা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার।
–আমি জানি, বন্ধু। কিন্তু ভাবলে দেখবে, দুটোর মধ্যে কেনো ফারাক নেই। কারণ দুটোই মৃত্যু। গাড়ি চাপা পড়লে যা পরিণতি হয়, অজ্ঞাত কোনো আতাতায়ীর হাতে খুন হলেও একই ফল হয়। হেস্টিংস, তুমি খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করো, তিন তিনটে খুন, অথচ ধরা পড়লো না। অর্থাৎ যারা যথার্থভাবে নির্দোষ, খুনী তাদের কোনোভাবেই আততায়ী বলে প্রতিপন্ন করতে দিলো না।