–আচ্ছা, উনি নৈশভ্রমণ সেরে কখন ফিরতেন?
দশটা নাগাদ, খুব বেশি হলে সোয়া দশটা, তিনি খিড়কি দরজা দিয়ে ঢুকে সোজা নিজের শোবার ঘরে চলে যেতেন। মাঝে মাঝে না শুয়ে গ্যালারিতে গিয়ে জিনিসপত্র দেখতেন, ঘাঁটাঘাঁটি করতেন। থানা থেকে খবর না দিলে আমরা জানতেই পারতাম না যে এমন একটা অঘটন ঘটে গেছে।
–ওঁর স্ত্রী নিশ্চয়ই খবরটা পেয়ে ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েছেন?
–না, ডাক্তার তার আগেই ঘুমের ওষুধ খাইয়ে বেহুশ করে দিয়েছে।
মিঃ ফ্রাঙ্কলিন আমাদের সমস্ত জায়গা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছিল। জায়গার নামও তার কাছ থেকে আমরা জানতে পারছিলাম। পায়ে পায়ে আমরা এগোচ্ছিলাম। হঠাৎ মিস গ্রে আমার বাঁ হাত চেপে ধরে আমার কাঁধে মাথা দিয়ে চোখ বুজলো। ওর দেহটা এলিয়ে পড়লো। মিঃ ফ্রাঙ্কলিন দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে ওর কাধ ধরে ঝাঁকুনি দিল।
-থরা, কি হলো? চোখ খোল, এখানে আমাদের আসাই ভুল হয়েছে। থরা, থরা বাড়ি চলো।
মিঃ ফ্রাঙ্কলিন আমাদের দিকে তাকিয়ে বললো, বুঝতেই পারছেন, এমন জায়গায় বেশিক্ষণ…
অতএব কি আর করা। ধীর পায়ে আমরাও ফিরে এলাম মৃতদেহটি নিজের চোখে দেখবো বলে। ততক্ষণে মিস গ্রে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। ফ্রাঙ্কলিনের হাত ছেড়ে দিয়ে আমাদের সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো।
ঘরের কাছাকাছি হতে আমরা লক্ষ্য করলাম সৌম্য শান্ত চেহারার এক প্রৌঢ় ডাক্তারি ব্যাগ হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
–ডাক্তার, কেমন দেখলেন? ফ্রাঙ্কলিন তাকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করলো।
–না, বিশেষ কিছু নয়। এটি একটি হত্যাকাণ্ড সহজ ও সাধারণ। শক্ত কোনো অস্ত্র নিয়ে মাথার পেছনে আঘাত করা হয়েছিল। যাই লেডি ক্লার্ককে একবার দেখে যাই। এলাম যখন, ডাক্তারবাবু সেখান থেকে চলে গেল।
আমি ঘরে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেলাম। রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মিস গ্রে-র দিকে দৃষ্টি চলে গেল। আমি তার পাশে গিয়ে বললাম–আপনি কি ভাবছেন?
–ভাবছি সেই পরবর্তী হতভাগ্যের কথা, যার নাম বর্গমালার চতুর্থ অক্ষর দিয়ে শুরু।
–সত্যি, তা যা বলেছেন। এভাবে কতদিন যে চলবে।
-ঠিক বলেছেন। কখন যে মিঃ ফ্রাঙ্কলিন আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। তার গলার আওয়াজ শুনে ফিরে তাকালাম।
-কাল রাত থেকে কেবল ভেবেই চলেছি। ফ্রাঙ্কলিন বলতে থাকে। কিন্তু কোনো কূল কিনারা খুঁজে পাইনি। ঠিক করলাম, এ ব্যাপারে সঁসিয়ে পোয়ারোর সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। বুঝলেন মিঃ হেস্টিংস, এ রহস্যের সমাধান করা ক্রোমের কর্ম নয়। কার দ্বারা কি হতে পারে আমি তোক দেখলে বুঝতে পারি। অবশ্য ইতিমধ্যে আমি একটা পরিকল্পনা করেছি। পরে পোয়ারোকে জানাবো।
ফ্রাঙ্কলিন আর কথা না বাড়িয়ে লেডি ক্লার্কের ঘরের দিকে চলে গেল।
-বারো ঘণ্টাও হয়নি খুনটা হয়েছে। থরা বললো, এর মধ্যে খুনী কি কর্পূরের মতো উবে গেল? পুলিশও তাকে ধরতে পারলো না, কেন? সেটা ভেবে পাচ্ছি না।
–পুলিশ ঠিক ধরতে পারবে। দুদিন আগে আর পরে…। আমি কথা বলতে বলতে পাশে তাকালাম। দেখি থরা ততক্ষণে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। মনে হয় হঠাৎ কিছু মনে পড়েছে তার।
আমি তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
.
এটা ক্যাপ্টেন হেস্টিংসের লেখা নয়, অতএব এমন ধারণা পোষণ করবেন না।
ছবিটার নাম শেষ পাখি।
ম্যাটিনি শো শেষ হলো, সবার বেরোবার তাড়া। হুড়োহুড়ি করে লোকেরা দরজার দিকে এগোতে থাকে।
তখন রাস্তার ফেরিওয়ালা নিউজ ডেইলি-র সন্ধ্যা সংস্করণ নিয়ে ছোটাছুটি করছে। কোটের পকেট থেকে খুচরো পয়সা বের করে একটি কাগজ কিনে কাস্ট সমুদ্রের ধারে গিয়ে নিরিবিলি জায়গা বেছে নিয়ে একটি বেঞ্চিতে বসলেন। কাগজের প্রথম পাতাটি মেলে ধরলেন চোখের সামনে
বড় বড় অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছে—
স্যার কার মাইকেলক্লার্ক নিহত। কানে শোকের ছায়া, খুনী উন্মাদের নতুন অপকীর্তি।
নীচে দুকলম জুড়ে ঘটনার পূর্ণ বিবরণ ছাপা হয়েছে।
বেক্সহিলে মাত্র একমাস আগে এলিজাবেথ বার্নার্ডের অদ্ভূত হত্যা রহস্যের ঘটনা হয়তো পাঠকদের মনে আছে। তার পাশে খোলা অবস্থায় একটা এ.বি.সি. গাইড পাওয়া গিয়েছিল। আবার মৃত স্যার কারমাইকেলের নিষ্প্রাণ দেহের পাশে ঐরকমই একটা গাইডবুক পাওয়া যায়। প্রশাসনের ধারণা, দুটি ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তিই নায়ক। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ…
-দেখুন দেখি, কি বিশ্রী কাণ্ডই না ঘটে গেল।
চমকে উঠলো কাস্ট। কাগজ ভাঁজ করে পাশে তাকালেন। এক যুবক তার পাশে বসে আছে।
-কাণ্ড…কাণ্ডই বটে, বিশ্রী, ভয়ঙ্কর।
–এই মত পাগলদের, কাস্টের হাত থেকে নিচে পড়ে যাওয়া কাগজটা তুলতে তুলতে যুবকটি বলতে থাকে, ওপর থেকে এদের চেনা ভীষণ অসুবিধা, আমার আপনার মতো সহজ সাধারণ দেখতে…
–তা যা বলেছেন।
–কিন্তু তফাত আছে। নেশার ঝোঁকে যেন যুবকটি কথা বলছে, হয়তো সে ভীষণভাবে কারো কাছ থেকে আঘাত পেয়েছে, হয়তো তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে যুদ্ধে পাঠানো হয়েছে, হয়তো বা…।
কাস্ট মাথা নেড়ে সায় দিলেন, আপনার কথা মিথ্যে নয়।
–আমি কিন্তু যুদ্ধ-টুদ্ধ পছন্দ করি না মোটেও।
–আমিও আপনার মতো। যুদ্ধ, প্লেগ, ক্যান্সার এদের ধারে কাছে যেতে নারাজ। এবার হো হো করে কাস্ট হেসে উঠলেন।
সামান্য কথাতে এত হাসির অর্থ কি, সেটা যুবকটি বুঝতে চেষ্টা করলো।