সব শুনে পোয়ারো মন্তব্য করলো–এবার খুনী শহরের মান্যগণ্য ব্যক্তি। হেস্টিংস, আমরা প্রথম থেকে খুনীকে উন্মাদ বা পাগল ভেবেছি, আসলে সেটা ভুল। একটা পাগল দিনের পর দিন নিপুণভাবে সুপরিকল্পিতভাবে একের পর এক খুন করে যাবে অথচ ঘুণাক্ষরেও সে ভুল করবে না। তার এই অদ্ভুত পরিকল্পনার আড়ালে একটা অদৃশ্য ইতিহাস আছে। সেটা আমাকে আবিষ্কার করতেই হবে।
স্থানীয় থানার পুলিশ অফিসার ওয়েলস স্টেশনেই ছিলো। স্টেশনে থেকে গাড়িতে করে আমরা তার সঙ্গে ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হলাম।
পথে যেতে যেতে পুলিশ অফিসার জানালো, রোজ খাওয়া-দাওয়া সেরে নৈশ ভ্রমণে বেরোনো মৃতের অভ্যাস ছিল। অন্যান্য দিনের মতো বেড়াতেও বেরিয়েছিল।
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের জরুরী নির্দেশ পেয়ে ভদ্রলোককে সাবধান করে দেওয়ার জন্য ওয়েলস তার বাড়িতে ফোন করে। কিন্তু তখনও সে বাড়িতে ফেরেনি। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা হবে। এত রাত পর্যন্ত সে কখনো বাইরে থাকতো না। ওয়েলসের মনে সন্দেহ জাগে। দেরি না করে লোকজন নিয়ে সে তার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। সে কোন পথ দিয়ে বেড়াতো সেটা মোটামুটি জানা ছিল। অতএব সেইমতো কিছুটা এগোতেই পথের পাশে ঝোঁপের মধ্যে তার মৃতদেহ নজরে পড়ে। উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ভারী কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়েছিল। তাই মাথাটা থেঁতলে গিয়েছিল। তার পাশে পড়ে আছে এ.বি.সি. গাইড বুক।
নির্দিষ্ট স্থানে এসে আমাদের গাড়ি থামলো। বাড়ির জন্য স্থান নির্বাচনে তার ভুল হয়নি একটুও। নাম-যশ সব পেয়েছিলো সে। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বাড়ির নাম রাখা হয়েছে নিরালা। বৃদ্ধ খানসামা ডেভরিন আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে ঘরে বসলো। তারপর সে মিঃ ফ্রাঙ্কলিনকে খবর দিতে চলে গেল।
তামাটে গায়ের রঙ, মুখের রেখায় ইস্পাত কাঠিন্য, ঝকঝকে দুটো নীল চোখে বুদ্ধির ছাপ পরিস্ফুট। ঘরে ঢুকে ফ্রাঙ্কলিন ক্লার্ক আমাদের সঙ্গে পরিচয় করলো। তারপর ব্রেকফাস্ট সাড়া হলো।
ইনসপেক্টর ওয়েলসের মুখে দাদার মৃত্যুর বিবরণ শুনলাম। ফ্রাঙ্কলিন বলতে থাকে। আমি তো ভেবে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। ভাবতে পারিনি দাদা সেই উন্মাদ, সেই পাগলটার…এ.বি.সি.-র হাতে মারা যাবে। কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। তাকে খুন করে খুনীর কি যে লাভ হলো এবং কেন করলো?
-এই কেন-র জবাব আমাদের সবার আগে খুঁজে বের করতে হবে। এটাই করা উচিত।
–কে শুনছে এই উচিত শব্দটি? খুনের রক্ত মাথায় চেপে গেলে হাতের কাছে যাকে পেয়েছে তাকে খুন করেছে। ঝোঁকের মাথায় খুন করে ফেলেছে এমন ঘটনা আমি অনেক দেখেছি।
ক্রোম বললো, আপনার দাদা কি কোনো বেনামী চিঠি…
-না, সেরকম কিছু শুনিনি।
–গতকাল সে অন্য দিনের মতো সুস্থ ও স্বাভাবিক কি ছিলো?
-তবে দাদার স্বাভাবিকত্ব ছিল কিছুটা অন্যরকম। উত্তেজক প্রকৃতি ছিল তার। তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়তো। কালকেও তার ব্যস্তবাগীশ চেহারার মধ্যে ব্যতিক্রম দেখিনি। তবে বৌদির অসুখের পর থেকেই তার এই সচেতনতা লক্ষ্য করি। আমার বৌদি ক্যান্সারে ভুগছে। সে কোনোদিন ভালো হয়ে উঠবে না। এটা প্রত্যেকেই মানে।
মনে করুন আপনার দাদা, পোয়ারো প্রশ্ন করলো, সমুদ্রের উপকূলে বালির ওপর অথবা নির্জন কোনো ঝোঁপের মধ্যে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে, পাশে একটা পিস্তল, তাহলে আপনার কি মনে হতো?
–তাহলে ভাবতাম, দাদা নিজে আত্মঘাতী হয়েছে।
–আচ্ছা, আপনার দাদা রোজই কি রাতের খাওয়া সেরে ভ্রমণে বেরোতেন?
–রোজই যেতো, তবে বৃষ্টি-বাদল হলে অবশ্যই বাদ পড়তো।
–তিনি যে রোজ রাতে ঘুরতে বেরোতেন সেটা কি সকলে জানতো? অর্থাৎ গ্রামের লোকজনও কি জানতো?
–ঠিক বলতে পারবো না। তবে জানাটাই স্বাভাবিক। কারণ এখানে তো লোকজনের সংখ্যা খুব বেশি নয়।
যদি কোনো অচেনা উটকো লোক গ্রামে প্রবেশ করে তাহলে যে কোনো লোকের নজরে নিশ্চয়ই পড়বে।
–জুলাইয়ের আগে হলে হ্যাঁ বলতাম। কিন্তু তারপর থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি এখানে সবসময় ট্যুরিস্টে ভর্তি থাকে। অতএব কারোকে স্বতন্ত্রভাবে আবিষ্কার করা সম্ভব নয়।
-কাল কি আপনার দাদার সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছিল?
–এটা ডেভরিন বলতে পারবে। ওকে জিজ্ঞেস করি।
ডেভরিন জানালো, চেনা বা অচেনা কোনো লোকই তার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি। এমন কি বাড়ির ধারেকাছে সন্দেহজনকভাবে কাউকে ঘুরঘুর করতেও সে দেখেনি।
ডেভরিন চলে গেল। ঘরে এসে ঢুকলো বছর সাতাশের এক যুবতী। মেয়েটিকে সুন্দরী বলা চলে। তার সঙ্গে ফ্রাঙ্কলিন আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল–দাদার সেক্রেটারি মিস গ্রে।
একটু দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে সে বললো, যদি আমি আপনাদের কোনো সহযোগিতা করতে পারি…
-আপনি তো স্যার মাইকেলের চিঠিপত্র দেখতেন, তাই না? ক্রোম প্রশ্ন করলো। আপনি কি এমন কোনো চিঠি পেয়েছেন যেটা এ.বি.সি. পাঠিয়েছে?
-না!
আমরা উঠে পড়লাম। ঘটনাস্থলের দিকে আমরা রওনা হলাম। সবার পিছনে মিস গ্রে আর আমি ছিলাম।
আমি গলা ঝেড়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, এমন একটা ঘটনা স্যার কারমাইকেলের মতো লোক…
-সত্যি, এ যেন অবিশ্বাস্য। আমি তো এখনও ভাবতে পারি না। রাতে আমি যখন বিছানায় শুয়ে তখন থানা থেকে খবরটা এলো। বাইরে ব্যস্ততা, শোরগোল শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। দেখি, ডেভরিন আর মিঃ ফ্রাঙ্কলিন বেরোবার জন্য তৈরি হচ্ছেন।