শুক্রবার দশটা নাগাদ দিনের শেষ এবং পঞ্চম ডাক এলো। পাঁচটা চিঠি নিয়ে আমি দেখতে লাগলাম, শেষ চিঠিটার দিকে তাকিয়ে আমি অস্ফুটে চেঁচিয়ে উঠলাম।
–পোয়ারো।
আমার বন্ধু তখন চোখ বুঝে চিন্তায় মগ্ন ছিলো। আমাদের কণ্ঠস্বরে সে চোখ খুলে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো, এসেছে নাকি? খুলে ফেলল। পড়ো।
আমি দেরি না করে চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম।
বেচারা পোয়ারো,
বলুন তো, আমার এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি। আপনি একজন স্বনামধন্য ডিটেকটিভ। বারে বারে এমন ব্যর্থতা। ছি ছি, ভাবতেও আমার লজ্জা লাগছে। আমি যদি আগে জানতাম, তাহলে এমন ক্ষুদ্র ব্যাপারে আপনাকে জড়াতাম না।
তা, দু-দুটো খেলায় আপনি হেরে গিয়ে বেশ ভুঝতে পারছনে, আপনার বুদ্ধি কতখানি। এবার আর একটা খেলা খেলবো আপনার সঙ্গে। তবে সেটা সহজ সরল সাদামাটা গোছের খেলা। জটিল খেলায় খেলতে নামিয়ে লাভ নেই।
…তিরিশে, হ্যাঁ, তারিখটা ভুলবেন না। এ মাসের তিরিশ তারিখে কার্স্টনে হবে খেলাটা। দেখুন আপনি এবার জিততে পারেন কি না। স্বীকার করতে দোষ নেই, আমার নিজেরও কেমন খারাপ লাগছে। নিজের খেলায় বার বার নিজেই অনায়াসে জিতে যাবো…তা কি কখনো কারো ভালো লাগে বলুন।
…আমি ঈশ্বরের কাছে আপনার শুভ কামনা প্রার্থনা করছি।
ইতি
বশংবদ
এ.বি.সি
কবে চিঠিটা লেখা হয়েছে, সেটা দেখো আর কবে খুন হবে? পোয়ারো আমাকে বললো।
–সাতাশে আগস্ট চিঠিটা লেখা হয়েছে। খুন হবে তিরিশ আগস্ট।
-তাহলে তো আজই খুন হওয়ার কথা। সে মেঝে থেকে চিঠিটা তুলে নিয়ে ভালো করে দেখে বললো-ই, ঠিকানাটা ভুল লেখা হয়েছে, হবে হোয়াইট হাউস ম্যানসন, তার পরিবর্তে বসানো হয়েছে হোয়াইট হর্স ম্যানসন। যাতে ডাকবিভাগ নাকানি-চোবানি খেয়েছে। তিনদিনে চিঠিটা পেলাম, হেস্টিংস, তুমি বরং এক কাজ করো, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে ফোন করে চিঠির ব্যাপারটা এক্ষুণি জানিয়ে দাও। সত্যি আমাদের ভীষণ দেরি হয়ে গেল। এখন দশটা বেজে কুড়ি। তার মানে হাতে আমাদের এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিট ময় আছে। হেস্টিংস দেখ তো, কান জায়গাটা ঠিক কোথায়?
জায়গাটা ডিভনের উপকূলবর্তী। ছোট্ট একটা গ্রাম। প্যাডিংটন থেকে দুশো চার মাইল ভেতরে। জনসংখ্যা পাঁচশো চুয়াল্লিশ।
জায়গার বর্ণনা শুনে পোয়ারো বললো–যাক, একটু নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। এত লোকের মধ্যে একটা আনাড়ি লোকের আবির্ভাব হলে কারো না কারো নজরে ঠিকই পড়বে। অতএব তার চেহারার বর্ণনা হয়তো আমরা তাদের কাছ থেকে পেতে পারি। একটু চুপ করে থেকে আবার বললো, দুশো চার মাইল রাস্তা গাড়ির চেয়ে ট্রেনেই ভালো। তুমি দেখ তো, কাস্টন যাওয়ার রাতের কোনো ট্রেন আছে কিনা?
-প্যাডিংটন থেকে ঠিক বারোটায় ট্রেন। নিউটন এ্যাবাট পৌঁছবে ছটা পাঁচে। সাতটা পনেরো নাগাদ ট্রেন হাজির হবে কানে।
-চলো বেরিয়ে পড়া যাক। তুমি তৈরি হয়ে নাও, আমি ততক্ষণ ক্রোমকে একটা ফোন করি। ফোন করে সে পিরে এসে জানালো, ক্রোমও আমাদের সঙ্গী হচ্ছে।
স্টেশনে ক্রোমের সঙ্গে আমরা মিলিত হলাম। সে জানালো, কানের সমস্ত সিঅক্ষরধারী নাম পদবীধারী মানুষকে সতর্ক করে দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত সব দিক রক্ষা হলেই ভালো।
চিঠিটা ক্রোমকে দেখানো হলো। সে বললো–যদি চিঠিটা সময়মতো এসে পৌঁছোত তাহলে শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা ভালোভাবে করা যেতো।
-যদি সে ইচ্ছা করেই ঠিকানাটা ভুল লেখে? আমি জানতে চাইলাম।
-না না, ভুল সে করবে না। নিয়মের ব্যতিক্রম হতে পারে না। ঠিক সময়েই সে চিঠিটা পাঠিয়েছে। দেরি করে পাওয়ার জন্য আমাদের কপাল দায়ী। হয়তো হোয়াইট হর্স হুইস্কির বোতল খুলে সে চিঠি লিখতে বসেছিল। তাই নেশার ঝেকে হ্যাভনের পরিবর্তে হর্স হয়ে গেছে।
ক্রোমের যুক্তি পোয়ারোর পছন্দ হলো। সে ঘাড় নেড়ে সায় দিলো।
এমন সময় স্টেশনে ট্রেন এসে ঢুকলো তীব্র বাঁশি বাজিয়ে। আমরা যে যার জায়গায় গিয়ে বসলাম। ট্রেন একসময় ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো।
এক সার্জেন্ট কি যেন খোঁজাখুঁজি করছিলো। তারপর ক্রোমের দিকে এগিয়ে এসে হাত-পা নেড়ে কি যেন বললো। খানিকবাদে সার্জেন্ট চলে গেল। আমরা ক্রোমের কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম সার্জেন্ট কি বলে গেল। ক্রোম বললো–কার্স্টনের সার্জন শ্রদ্ধেয় স্যার কার মাইকেল ক্লার্ক খুন হয়েছে। ভারী কোনো অস্ত্র দিয়ে তার মাথাটা একেবারে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে।
চক্ষু বিশেষজ্ঞ হিসেবে এই শান্ত সদাশয় নিঃশত্ৰু মানুষটি একসময় খুব নাম করেছিলো। সম্প্রতি এই কাজ থেকে সে অবসর গ্রহণ করেছে। জীবনের বাকি দিনগুলো নিরিবিলিতে কাটানোর জন্য সে ডিভনের প্রাকৃতিক পরিবেশ পছন্দ করেছিলো। চাকরি করাকালীন সে অনেক অর্থ রোজগার করেছে। বছর তিনেক আগে এক দূর সম্পর্কের কাকার সম্পত্তি সে লাভ করে। সংসারে কেবল স্ত্রী এবং ভাই ফ্রাঙ্কলিনকে নিয়ে বাস করতো। ভাই বিয়ে করেনি। নিজের সন্তানও ছিল না। অথচ বিস্তর টাকা। খরচ তত করতে হবে। হালে তার একটা নেশা হয়েছিল। শহরের পুরানো জিনিস বিক্রির দোকান ঘুরে দেশীয় বস্তু সংগ্রহ করতো। ফলে তার এক বিরাট সংগ্রহশালা গড়ে ওঠে। সেখানে চীনের মাটির বাসনপত্র থেকে চীনের কারুকার্যখচিত পোশাক ও আসবাবপত্র ছিলো।