কথার মাঝখানে টম্পসন বলে উঠলো…তার আগে আমাদের ভালো করে জানতে হবে খুনী আসলে অদ্ভুত না কি আমাদের মতো সাধারণ।
-নতুন কিছু না ঘটা পর্যন্ত আমাদের চুপ করে থাকা উচিত। ক্রোম মন্তব্য করলো।
ক্রোমের কথায় পোয়ারো সমর্থন করলো। প্রচার হলে হয়তো তৃতীয় খুন আবার অনুষ্ঠিত হবে।
-কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি হয়তো খুনীর মনস্তত্ত্বটা বুঝে উঠতে পারেননি। ক্রোম বললো, তাই এখানে অসুবিধা হচ্ছে। পৃথিবীর সেরা চালাক লোক হিসাবে খুনী নিজেকে মনে করে। তাই একের পর এক খুন করে শেষ রক্ষা করতে পারে না।
-বেক্সহিলে তদন্ত করে কিছু আবিষ্কার করেছেন আপনি? পোয়ারো ক্রোমের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো।
না, বিশেষ কিছু নয়। নিছক কয়েকটা খবর মাত্র। ইস্টবোনের স্ পেলম ডাইভ রেস্তরাঁর এক বেয়ারা মেয়েটির ছবি দেখে চিনতে পারলো।
সে জানিয়েছে, ঘটনার দিন রাতে মেয়েটির সঙ্গে একজন মধ্যবয়স্ক চশমাওয়ালা ভদ্রলোক ছিল। তারা একসঙ্গে ডিনার করেছে। বেক্সহিল ও লন্ডনের মাঝামাঝি এক চায়ের দোকানের মালিকও ঐ একই কথা জানিয়েছে। ভদ্রলোককে দেখে তার মনে হয়েছিল, নিশ্চয়ই সে জাহাজের অফিসার অথবা ঐ ধরনের কিছু। অতএব দুজনের কথার মধ্যে সাদৃশ্য আছে একটা–ঘটনার রাতে বেটি বার্নার্ডের একজন সঙ্গী ছিলো এবং আমাদের ধারণা যদি ঠিক হয়, তাহলে ঐ সঙ্গীটিই হলো তার খুনী।
পোয়ারো নীচু কণ্ঠে বলে উঠলো, আমাদের সর্বপ্রথম খুনের মোটিভ জানতে হবে। তাহলে সূত্রের সন্ধান পেতে অসুবিধা হবে না।
-মোটিভ তো জলের মতো পরিষ্কার।
বর্গমালার ব্যাপারটা হয় যে কোনো প্রকারে তার মাথায় ঢুকে গেছে, তাই এটাকে নিয়ে সে ক্ষেপে উঠেছে। আসলে খুনী একজন বিকারগ্রস্ত লোক। সে মোটেও সুস্থ নয়। বিবেকবুদ্ধিহীন বদ্ধ উন্মাদ।
কিন্তু বিকারের ঘোরেনা, সে যা করে সবকিছুর পেছনে তার অবচেতন মনে একটা যুক্তি, একটা কারণ থেকে যায়।
মাথা নেড়ে ক্রোম সায় দিল।
–যুক্তি থাকতেই হবে এমন কোনো মানে নেই। ১৯২৯-এ সেই স্টোনম্যান যে কোনো যুক্তির তোয়াক্কা করতো না। তাকে কেউ বিরক্ত করলে সে তাকে ঘৃণা করতো।
কিন্তু এখানে একটা কারণ আছে। বিরাট এক সূত্রের চিরন্তন ব্যবধান, যেমন ধরুন কোনো মাছি বা মশা দুবার আপনাকে বিরক্ত করলে আপনি কি তিনবারের পর তাকে মেরে ফেলবেন। এখানে মাছি আর আপনার মধ্যে ক্ষুদ্র-বৃহতের একটা প্রাচীর আছে। স্টোনম্যানের নাম কে না জানতো। সে কোনো ক্ষুদ্র ব্যক্তির বেয়াদপি সহ্য করতো না। তাই সে নির্দ্বিধায় খুন করতো।
পোয়ারোর বিশ্লেষণ শুনে টম্পসন খুশী হলো। বললো–আপনার কথা অনুযায়ী বলা যায়, খুনীর যখন মাথায় খুন চাপে তখন সে কোনো কিছু তোয়াক্কা করে না। একের পর এক লোককে হত্যা করে সে পরিতৃপ্তি লাভ করে। কিন্তু এখানে একটু ব্যতিক্রম আছে। ঐ চিরাচরিত নিয়ম প্রযোজ্য নয়। অবশ্য খুনির উদ্দেশ্য যদি যৌন বিকার হয় তাহলে স্বতন্ত্র ব্যাপার। যে দুজন খুন হয়েছে তারা দুজনেই মহিলা। তাই এখনই কোনো সিদ্ধান্তে না পৌঁছিয়ে পরবর্তী।
পোয়ারো ইতস্ততঃ করে বললো, এটাকে আমি পাগলামি বা ফাজলামি বলে মনে করি না। অবশ্য সম্পূর্ণ ব্যাপারটা এখনও আমার কাছে আবছা কুয়াশায় ভরা। প্রতিটি খুনের আগে এরকুল পোয়ারোর নামে সে তীব্র শ্লেষ, চ্যালেঞ্জের প্রছন্ন আহ্বান জানিয়েছে। তবে…তবে কি তার আক্রোশ আমার ওপর? আমি কি জ্ঞানে বা অজ্ঞানে তার কোনো ক্ষতি করেছি। তাই কি সে একের পর এক খুন করে গায়ের জ্বাল মেটাচ্ছে? অথবা, আমাকে পছন্দ করে না, আমি বিদেশী বলে এর কারণ কি?
–আপনার কথাগুলো খুব তাৎপর্যপূর্ণ। টম্পসন বললো।
ঝট করে ক্রোম বলে উঠলো–কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর নেই। তার কথায় কেমন ব্যঙ্গ লক্ষ্য করা গেল।
–ঠিক বলেছেন, এই প্রশ্নগুলোর মধ্যে আমার রহস্যের সমাধান লুকিয়ে আছে। পোয়ারো ক্রোমের কথার জের টেনে বললো। যদি এই প্রশ্নগুলির কোনো একটির জবাব আমার জানা থাকতো তাহলে খুনীর তৃতীয় শিকারের নাম-ধাম জানতে আমার বেগ পেতে হতো না। তবে খুনী যে মহান, উদার সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একটা জিনিস লক্ষ্য করুন, মিসেস এ্যাম্বারের খুনের সঙ্গে তার স্বামীকে জড়িয়ে ফেলা হলো, আবার বেটি বার্নার্ডের হত্যাকারী হিসেবে স্বাবাবিক ভাবেই ডোনাল্ড ফ্রেসারের নাম চলে আসছে। কিন্তু তাদের কাউকে গ্রেপ্তার করা হলো না। এর কারণ কি? এর মূলে আছে ঐ বেনামী চিঠি দুটি। সে চিঠিতে তার অপরাধের কথা স্বীকার করেছে। সে তার অপরাধের বোঝা অন্য কারোর ঘাড়ে চাপাতে চায় না। এটাই তার মহৎ মনের প্রমাণ।
-তাহলে পরের চিঠি পাওয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করি। ক্রোম বললো। তারপরেই আমরা জনসাধারণের কাছে সব প্রকাশ করবো। এর ফলে সমস্ত মানুষ সর্বদা সচকিত থাকবে। আততায়ী যখন তার কাজ হাসিল করতে যাবে তখন স্বাভাবিকভাবে হাতেনাতে ধরা পড়বে।
অবশেষে তিন নম্বরে চিঠি হাজির হলো। বার্নার্ডের ঘটনার পর থেকে স্যার লায়নেলের হুকুমে পোয়রোর দরজায় চব্বিশ ঘণ্টা পাহারার ব্যবস্থা হলো। আমরা যখন বাড়ির বাইরে যাই তখন সার্জেন্টটি বেশি সতর্ক থাকে, কারণ খুনীর তৃতীয় চিঠিটা আসার সেই মুহূর্তেই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে যাবে দেরি না হয়। আমাদের অনুপস্থিতিতে আমাদের চিঠি সে খুলে পড়তে পারে। এমন নির্দেশ তার ওপর দেওয়া আছে।