নিজের মত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সম্পূর্ণ পাল্টে ফেললল এ্যানথনি ব্রাউন। সে তখন অন্য মানুষ অন্য মন নিয়ে হাজির হলো রোজমেরির সামনে।
.
স্টিফেন ফ্যারাডে
১.৪
স্টিফেন ফ্যারাডের সেই অবিশ্বাসী মন আজও বিহ্বল করে তোলে রোজমেরির কথা ভাবতে বসলে। বার বার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই রেস্তোরাঁর প্রথম দৃশ্যটা।
এক অদ্ভুত আচ্ছন্নতা তাকে মনে করিয়ে দেয় তার জীবনের অতীতকে। জীবন তার দুটি ভাগে বিভক্ত। বড় অংশে আছে স্থির মস্তিষ্কসম্পন্ন একজন মানুষের আশা-আকক্ষা, উন্নতির নাসনা–অন্যটি মেরুদণ্ডহীন, অনুভূতিশূন্য জীবন।
মাত্র সাত বছর বয়সে সে জেনে গিয়েছিল তার কপালের লেখা কেউ মুছে ফেলতে পারবে না। সেই লেখা ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন সৎ ইচ্ছা ও মনের জোর। অভিভাবকদের দ্বারা তার কোনো উপকার হবে না। নিজের ভবিষ্যৎ নিজেকেই গড়ে তুলতে হবে। এটা সে ঐ বয়সেই উপলব্ধি করতে পেরেছিল।
এই দৃঢ় মনোভাব নিয়ে স্টিফেন নিজের জীবন সুচারুরূপে চিত্রায়িত করেছিল। সে একটু তোতলা ছিল। তাই প্রথমেই সে আন্তরিক চেষ্টার ফলে স্বাভাবিকভাবে কথা বলা শিখলো। লেখা পড়ায় ভালো ছিল। স্কলারশিপ পেতে তার খুব বেশি দেরি হয়নি।
মাত্র বাইশ বছর বয়সে অক্সফোর্ড থেকে ডিগ্রি নিয়ে সসম্মানে বেরিয়ে এলো স্টিফেন। হয়ে উঠলো একজন নামকরা লেখক ও সুবক্তা। স্বাভাবিক জড়তা কাটিয়ে উঠে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মেলামেশা করার প্রবণতা জাগে তার মধ্যে। পরবর্তীকালে রাজনীতি তাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করলো। লেবার পার্টিতে যোগ দিল। কিছুদিনের মধ্যে নিজেকে প্রতিভাবান যুবক হিসাবে চিহ্নিত করলো।
কনজারভেটিভ পার্টি তখন স্টিফেনকে লেবার পার্টির একটা শক্ত ঘাঁটি থেকে তাদের প্রার্থী মনোনীত করে। জয়ী হয়ে হাউস অব কমন্সের আসনে বসলো। সেই থেকে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। জনসাধারণকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা তার মধ্যে ছিলো। কখন তাদের তোষামোদ করতে হয়, কখন তাদের বিপক্ষে যেতে হয় সে সম্পর্কে সে ছিল সচেতন। ক্যাবিনেটে তাকে প্রবেশ করতেই হবে এই ছিল তার প্রতিজ্ঞা।
বিয়ে করা তার এখনও হয়ে ওঠেনি। সে ব্যাপারে খুব কমই চিন্তা করেছে। তবে এমন একজন জীবনসঙ্গিনী তার চাই, যে হবে সুন্দরী। তার সঙ্গে কাজে সহযোগিতা করবে। তার সুখ-দুঃখে সমান অংশীদার হবে, খুশী মনে তার সন্তানদের প্রতিপালন করবে। সেই নারী তার সাফল্যে যেমন গর্বিত হবে তেমনি ব্যর্থতায় সমবেদনা জানাতে এগিয়ে আসবে তার হৃদয়ের সব অনুভূতি উজাড় করে দিয়ে।
সেদিন কিডারমিনস্টার হওয়াতে এক বিরাট অভ্যর্থনা সভার আয়োজন হলো। স্টিফেনও ওখানে অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলো।
ইংলন্ডে কিডারমিনস্টার দারুণ প্রভাবশালী। লর্ড কিডারমিনস্টারের চেহারায় রীতিমতো রাজকীয়, দীর্ঘদেহী সুপরিচিত। এককথায় সবাই তাকে চেনে। যে কোন পাবলিক মিটিং-এ বা ইংলন্ডের যে কোনো কমিটির সভানেত্রীর স্থান অলঙ্কৃত করতে দেখা যায় লেডি কিল্ডারমিনস্টারকে। তাদের পাঁচ কন্যা, একটি পুত্র। কন্যাদের মধ্যে তিনজন ছিলো খুব সুন্দরী, গম্ভীর প্রকৃতির।
লোকে লোকারণ্য। জনারণ্য থেকে দূরে একটা নির্জনে দাঁড়িয়েছিল সে। হঠাৎ স্টিফেনের নজরে পড়লো টেবিলের সামনে একা দাঁড়িয়ে দীর্ঘাঙ্গী এক মহিলা, পরনে মেঘে ঢাকা পোশাক, অগোছালো ভাব, লেডি আলেকজান্ডার হেইলি আর্নের, কিডারমিনস্টারের তৃতীয় কন্যা।
কিডারমিনস্টারদের পাঁচ,মেয়ের মধ্যে এই আলেকজান্ডার মেয়েটিই অন্য মেয়েদের থেকে আলাদা। স্টিফেন জানতো মেয়েটা অসুস্থ ও অসুখী।
মেয়েটির পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে। টেবিলের ওপর থেকে একটুকরো স্যান্ডউইচ তুলে নেয়। তারপর ঘুরে গিয়ে বললো, আপনার সঙ্গে কথা বললে আপনি কি কিছু মনে করবেন? সত্যি কথা বলতে কি আমি ভীষণ লাজুক। আপনিও মনে হয় লাজুক, তাই না?
মেয়েটি শান্তভাবে স্টিফেনের অনুমানকে স্বীকার করে নিলো।
–এক একসময় আমার কথা জড়িয়ে যায়। এরকম অবস্থায় আর কেউ পড়েছে কিনা জানি না।
-আমারও তাই।
স্টিফেন তার সঙ্গে চলতি একটা নাটকের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। সেই নাটকটা সান্দ্রাও দেখেছিল।
সেই সময় লেডি কিডারমিনস্টার ঘরে এসে প্রবেশ করলেন।
নিজের পরিচয় গোপন রেখে সে অস্ফুটে বিদায় সম্ভাষণ জানায়।
-আপনার সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পেলাম। এখানে সব কিছু একঘেয়ে। ওদের মেপে মেপে কথা বলা, নোক দেখানো ভদ্রতা আমার অসহ্য লাগে।কিন্তু আপনার সঙ্গ খুব ভালো লাগলো। তার জন্য ধন্যবাদ।
বেশ কয়েকদিন পর সান্দ্রাকে আবার সে দেখতে পেলো কিডারমিনস্টার হাউসের বাইরে চার বোনদের সঙ্গে বা কখনো একা। তারপর সেদিন সেই পার্টির এক সপ্তাহ পরে এক সকালে একটি কালো কুকুর সঙ্গে নিয়ে অলস পায়ে পায়ে পার্কের দিকে এগিয়ে চললো।
পাঁচ মিনিট পরে সান্দ্রার সামনে এসে দাঁড়ায় স্টিফেন। চোখে মুখে হাসি উপছে পড়ছে।
–আমার কি সৌভাগ্য। আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে ভাবতে পারিনি।
মেয়েটির মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো।
কিছুক্ষণ ওদের মধ্য কুকুরটির সম্পর্কে আলোচনা চললো।
–সেদিন আপনাকে আমার পরিচয় দিইনি। আবেগ জড়ানো গলায় বললো–আমার নাম স্টিফেন ফ্যারাডে। আমি এক অজ্ঞাত এম.পি.।