গ্যাসের আগুনের সামনে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে আইরিস। মনে হয় ইতিমধ্যে অনেক গ্যাস তার পেটের মধ্যে চলে গেছে। মুখ এবং নাক কেমন বিশ্রী দেখাচ্ছিল। এ্যানথনি আর রেস তাকে ধরাধরি করে নিয়ে এলো ঘরের মাঝখানে।
ততক্ষণে জানলাগুলি খুলে দেওয়ায় ঘরের গ্যাস বেরিয়ে গেছে বেশ কিছুটা।
–মিঃ এ্যানথনি, ঘাবড়াবার কিছু নেই। রেস তাঁকে পরীক্ষা করে বলে, আপনি বরং ডাক্তারকে খবর দিন।
হলঘরে চলে এলো এ্যানথনি। রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়াল করতে গিয়ে বাধা পায়। পেছনে লুসিলা ড্রেক। এ্যানথনি একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে।
-কি হয়েছে? আমি জানতে চাই? লুসিলা ড্রেক অস্থির হয়ে ওঠেন। আইরিস কি অসুস্থ?
বন্ধ এবং গ্যাসপূর্ণ ঘরে গ্যাসের আগুনের সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল আইরিস।
–আইরিস? মিসেস ড্রেকের গলা থেকে আর্ত চিৎকার বেরিয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত ও কি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলো? এটা বিশ্বাসযোগ্য ব্যাপার নয়। আমি মানতে রাজী নই।
–আপনাকে জানতেও হবে না। এ্যানথনির ঠোঁটে ব্যঙ্গের হাসি। শ্লেষের সুরে বললো, কেন, এটা কি মিথ্যে?
.
৩.১৪
আইরিস ক্লান্ত চোখে এ্যানথনির দিকে তাকায়।
–এত সব কাণ্ডকারখানা কি করে হলো দয়া করে আমায় বলবে কি, টিম?
আইরিস সোফার ওপর শুয়েছিল। নভেম্বর মাস। সূর্যের প্রখর আলোয় হঠাৎ যেন লিটল প্রায়রস সাহসী হয়ে উঠলো।
কর্নেল রেস বসে আছে উইনডো সীলের ওপর। এ্যানথনি তাকে একবার লক্ষ্য করলো। তারপর বলতে শুরু করলো।
–আমি এই ক্ষণটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সেটা বলতে আমার দ্বিধা হচ্ছে না। নিজের বুদ্ধির জাহির যদি না করি তাহলে সেটা নিজের ওপর ভীষণ অবিচার করা হবে।
..রোজমেরির মৃত্যু আত্মহত্যা বলে স্বীকৃতি পেয়েছিল। কিন্তু আসলে ওটা আত্মহত্যা নয়। তাই জর্জ ওঁর স্ত্রীর মৃত্যুকে স্বীকার করে নিতে পারেননি বলে নিজেই গোপনে তদন্ত শুরু করেছিলেন। রোজমেরির খুনীও তাকে খুন করলো। তবে এর পাশাপাশি কয়েকটি প্রশ্ন বিতর্কের সৃষ্টি করে। যেমন, (ক) বিষপ্রয়োগে জর্জের মৃত্যু হতে পারে না, (খ) জর্জকে বিষপ্রয়োগ করেই খুন করা হয়েছে, (গ) জর্জের গ্লাস কেউ স্পর্শ করেনি, (ঘ) জর্জের গ্লাস নিশ্চয়ই কারো হাতের মধ্যে এসে থাকবে।
..ব্যাপারটা খুব ভালো করে খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে–সেই রাতের পার্টির সমস্ত গ্লাস এবং কফির কাপগুলো ছিলো একই মাপের এবং একই ডিজাইনের। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হবে।
যেমন, আমি, কেম্প আর রেস তিনজনে একটা গোল মার্বেল টেবিলের সামনে বসে চা খাচ্ছিলাম। ঘরে ঐ ধরনের আরো টেবিল আছে। রেস চা খাচ্ছিলেন বিনা চিনিতে, কেম্প চিনি মেশানো চা খাচ্ছিলেন আর আমি কফি পান করছিলাম। কোনো একটা অজুহাতে আমি ওদেরকে টেবিল ছেড়ে বাইরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলাম। কেম্প তার হাতের পাইপটা তার চায়ের প্লেটের পাশে রেখে বাইরে গেলেন। আমি তাদের অলক্ষ্যে পাইপটা নিয়ে আমার প্লেটের পাশে রাখলাম। পরে সবাই ঘরে ফিরে এলো। কেম্প তার ফেলে যাওয়া পাইপ লক্ষ্য করে সেই চেয়ারটায় বসলেন। চায়ের কাপে ঠোঁট লাগালেন। কেমন বিস্বাদ ঠেকলো। সেইরকমই রেস তার কাপে ঠোঁট লাগিয়ে মুখ বিকৃত করবেন। এক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী বিকৃতির আদান-প্রদান দেখা যাবে। এবার বিতর্ক হলো, চায়ের কাপে চিনি ছিলো না, আবার বলা যেতে পারে, হ্যাঁ, চিনি ছিলো। এই বিতর্কের মূলে কাজ করছে কেম্পের কাপটা। কারণ ঘর ছেড়ে তিনি যখন চলে যান তখন ছিলো এক কাপ, পরে তিনি এসে বসেন অন্য কাপের সামনে। তার মানে এখানে কাপের প্রভেদ দেখা যাচ্ছে।
…সেদিন রাতে লুক্সেমবার্গে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। আইরিস, তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, ক্যাবারে নাচে যোগ দিতে যাওয়ার সময় তুমি ভুল করে তোমার ব্যাগটি টেবিলের নিছে ফেলে রেখে যাও। সেটা তুলে দিয়েছিলো রেস্তেরাঁর একটি অনভিজ্ঞ ছেলে। পরিচিত ওয়েটার হলে ঠিক খেয়াল করে তোমার জিনিস তোমার চেয়ারের সামনে টেবিলে রাখতো। কিন্তু এক্ষেত্রে ছেলেটি না জেনে ব্যাগটি মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিয়ে ভুল করে তোমার বাঁ পাশে রেখে দেয়। ফলে ক্যাবারে থেকে ফিরে তুমি যথারীতি তোমার ব্যাগ লক্ষ্য করে যে চেয়ারটায় বসলে আসলে ওটা নির্দিষ্ট চেয়ার নয়। তুমি বসেছিলে জর্জের চেয়ারে। আর জর্জ বসলেন তোমার চেয়ারে। এবার জর্জ গ্লাসে চুমুক দিলেন, যেটি তোমার জন্য নির্দিষ্ট ছিলো। ঐ গ্লাসে অনায়াসে বিষ মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
…এবার সমস্ত ব্যাপারটা ভালো করে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখো। আসলে তুমি ছিলে আততায়ীর দ্বিতীয় লক্ষ্য। কিন্তু জর্জের দুর্ভাগ্য। একটু ভুলের জন্য তার প্রাণটা গেল। এই ভুল শব্দটা পাল্টে দিলো সব কিছু। নতুবা সৃষ্টি হতো একই রকম, গতবছর পার্টির পুনরাবৃত্তি ঘটা এবং তোমার দিদির মতো তোমার খুন হওয়াটাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হতো। ব্যাপারটা আরো সত্যি বলে প্রমাণিত হতো, এই কারণে, যে তোমার ব্যাগে সায়ানাইডের প্যাকেট পাওয়া গিয়েছিল। তুমি যে আত্মহত্যা করেছে সেটাই জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যেতো।
…এ সবের মূলে কি জানো, অর্থ। অর্থই অনর্থের মূল। রোজমেরির মৃত্যুর পর তুমি পেয়েছে তার বিশাল সম্পত্তি। তারপর তুমি যদি অবিবাহিত অবস্থায় মারা যেতে তাহলে এই সম্পত্তির মালিক হতো তোমার নিকট আত্মীয়া লুসিলা পিসি। তাই সব দিক থেকে বিচার করে আমি বলছি, এই খুনের জন্য দায়ী লুসিলা ড্রেক। মিসেস ড্রেকের মৃত্যুর পর এই সম্পত্তি আইনগতভাবে পাবে ভিক্টর ড্রেক। অতএব স্পষ্ট ভাবে বলা যায়, প্রথম খুনের জন্য দায়ী হলো ভিক্টর ড্রেক।