–আমি নিজেও তাই চাই। কিন্তু তার মায়ের কথা ভেবে অস্থির হচ্ছি। দুষ্টু ছেলে হলেও সে তো মায়েরই ছেলে। লুসিলা পিসি কিভাবে তার ছেলের জেলে যাওয়ার ব্যাপারটা নেবেন তাই ভাবছি।
-তোমার মতো এতো ভালো লোক আর বোধহয় পৃথিবীতে নেই।
রুথের কথায় জর্জ খুশী হলেন। রুথের একটা হাত তুলে নিয়ে চুমু খেলেন।
রুথ ভাবলো, জর্জকে পেলে তারা দুজনেই সুখী হবে।
এদিকে তখন জর্জ ভাবছিলেন, রেসের পরামর্শ মেনে নেবে কি না? সব ভাবনা চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দেবে কি না? পরক্ষণেই মনের সব দ্বিধা কাটিয়ে ওঠেন। পরিকল্পনামাফিকই কাজ হবে।
লুক্সেমবার্গ।
অতিথিদের সবাইকে উপস্থিত দেখে জর্জ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মনে একটু খটকা ছিলো, শেষ পর্যন্ত সবাই আসবে কি না। অবশেষে সবাই তার জালে ধরা পড়েছে। এখন কেবল নাটক শুরু হওয়ার অপেক্ষায়।
হলের একেবারে শেষ প্রান্তে একটা নিরালা জায়গায় তিনটি টেবিল পাতা ছিলো। মাঝের টেবিলটা বড়। দুপাশে দুটি ছোট টেবিল। একটি টেবিলে বসেছিল মাঝবয়সী একজন বিদেশী এবং এক সুন্দরী যুবতী। অপর টেবিলে বসেছিল দুটি যুবক-যুবতী। মাঝের টেবিলটি বারটন পরিবারের জন্য সংরক্ষিত ছিল।
জর্জ অতিথিদের বসার নির্দিষ্ট আসনগুলি অমায়িক ভঙ্গিতে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন।
জর্জের ডানদিকে বসলো সান্দ্রা, তার পাশে ব্রাউন। তার বাঁদিকে বসলো আইরিস, তারপর স্টিফেন, তার পাশে রুথ।
রুথ আর এ্যানথনির মাঝখানে একজনের বসার জায়গা ফাঁকা রইলো। সাতজন বসার উপযোগী টেবিল।
–আমার বন্ধু রেসের আসতে একটু দেরি হতে পারে। তার জন্য অপেক্ষা করতে বারণ করেছে। পৃথিবীর অনেক জায়গা সে ঘুরেছে। আলাপ হলে অনেক চমকপ্রদ গল্প তোমরা শুনতে পাবে।
আইরিস কিন্তু মনে মনে ক্ষুব্ধ হলো ব্রাউনের পাশে না বসতে পেরে। জর্জ ইচ্ছে করেই, এই ব্যবস্থা নিয়েছে। তার মানে জর্জ তাকে বিশ্বাস করেন না এবং পছন্দ করেন না।
আইরিস দেখলো, এ্যানথনি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে।
একটু পরেই তারা নাচের আসরে যায়।
এ্যানথনির সঙ্গে আইরিস যখন নাচ শুরু করলো, তখন আইরিস ফিস ফিস করে তার কানে কানে বললো, এর থেকে বোঝা যায়, জর্জ চায় না, আমরা দুজনে পাশাপাশি বসি।
-তাই তো আমি তোমাকে আড় চোখে লক্ষ্য করছিলাম।
-কিন্তু তুমি যে তাড়াতাড়ি চলে যেতে চাইছে, সেটা হবে না। তুমি জানো, কর্নেল রেসের এখানে আসার কথা আছে।
–আমার ধারণার বাইরে। কিন্তু আমাকে যেতেই হবে।
–উনি কি ধরনের লোক তুমি জানো?
–ওঁর সম্বন্ধে সঠিক খবর কেউ জানে না।
প্রত্যেকে আবার টেবিলে ফিরে এলো। বাইরে তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে ধীরে ধীরে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। উত্তেজনা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। টেবিলের চারধারে আতঙ্ক দানা বেঁধে ওঠে। কিন্তু জর্জ নিরুদ্বেগ, নিরুত্তাপ, তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না।
হঠাৎ ড্রাম বাজার শব্দ। ঘরের আলো স্তিমিত হলো, সঙ্গে সঙ্গে তিনজোড়া নারী-পুরুষ নাচে মেতে উঠলো। নাচের সঙ্গে সঙ্গে একজন বহুরূপী মুখে নানারকম আওয়াজ করে তাদের মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ বাদে ঘরের আলো জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলো।
সেই সময়ে উপস্থিত সকলের মধ্যে অবচেতন মন কথা বলে উঠলো–একটা অঘটন কিছু আবার বোধহয় ঘটে যাচ্ছে। যখন আলোগুলো ম্লান করে দেওয়া হয়েছিল সেই দৃশ্য তাদের কাছে জীবন্ত হয়ে ধরা দিলো। কেন সেই বিপদ ভরা অতীত তাদের মনে আসছে? তবে কি এর আড়ালে কোনো ইঙ্গিত আছে? বীভৎস ছায়াটা একসময় মিলিয়ে গেল।
কেবল জর্জ তার দৃষ্টি স্থির করে বসে আছেন তার উল্টোদিকের খালি চেয়ারটায়। যে কোনো মুহূর্তে সেই খালি চেয়ারে কেউ একজন এসে বসতে পারে। সামনে শ্যাম্পেনের গ্লাস।
–ওঠো জর্জ। আইরিসের ডাকে চমক ভাঙলো জর্জের। আজ এখনো পর্যন্ত তুমি আমার সঙ্গে নাচোনি। এসো, আমরা নাচ করি।
জর্জ উঠে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে শ্যাম্পেনের গ্লাস হাতে তুলে নিলেন।
–আজ আমরা আইরিস মারলের জন্মদিনের উৎসবে এখানে মিলিত হয়েছি। আমরা সকলে তার জীবনের শুভ কামনা করি। আসুন, আমরা এবার একটু পান করি।
প্রত্যেকে হাসতে হাসতে শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দেয়। তারপর তারা নাচতে শুরু করলো –জর্জ-আইরিস, স্টিফেন-রুথ এবং এ্যানথনি-সান্দ্রা।
কিছুক্ষণ বাদে সকলে যার যার আসনে এসে বসলো।
জর্জ হঠাৎ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন।
–তোমরা সকলে জানো, একবছর আগে এখানে এক বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটে। আমরা সেই বিষাদভরা অতীতকে স্মরণ করতে চাই না। কিন্তু রোজমেরিকে আমরা সকলে ভুলে গেছি, একথা আমরা ভাবতে পারি না। তাই বন্ধু, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ, রোজমেরির আত্মার উদ্দেশ্যে স্মরণ করে এসো আমরা শ্যাম্পেনের গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়াই।
জর্জ গ্লাস তুলে নিল হাতে। প্রত্যেকে তাকে অনুসরণ করলো। গ্লাস ঠোঁটে স্পর্শ করল। সবাই।
কয়েক মুহূর্ত পরে দেখা গেল জর্জের দেহটা কেঁপে উঠলো। ওঁর ভারী দেহটা চেয়ারের ওপর এলিয়ে পড়লো। তিনি তার উত্তেজিত দুটি হাত কণ্ঠের ওপর চেপে ধরলেন। ধীরে ধীরে তার মুখের রঙ পাল্টে গেল। নিঃশ্বাস নেবার জন্য আকুলিবিকুলি করলেন।
কিন্তু মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে জর্জের জীবন্ত দেহটা পরিণত হলো একটি নিথর নিস্পন্দ মৃতদেহ।
৩. নিউ স্টকল্যান্ড ইয়ার্ডে
৩.১