আইরিস হেসে বলে–তাহলে তো ভালোই হবে। রুথের ব্যাপারে তুমি যা বললে আমার মনে হয় সেটা ঠিকই। জর্জ ওর খুব প্রিয়। তাছাড়া রুথ হবে ওর আদর্শ স্ত্রী।
-ভালো খাবার এবং এবং তার ভালো মন্দের দেখার ভার নিতে পারে এমন একটি মেয়ের কথা তুমি বলছো তো? সেক্ষেত্রে তোমার মতো আকর্ষণীয় এক যুবতীই তার পক্ষে উপযুক্ত। তুমি বাড়ির বাইরে ভেতরে দুদিক দেখতে পারবে। তার জন্য জর্জকে তো ঐ মেয়েটাকে প্রয়োজন নেই।
আইরিস মৃদু হেসে মাথা নাড়লো। তর্ক করলো না। রুথের কথা সে তখন ভাবছিল। রুথ দেখতে শুনতে ভালো। অফিসের কাজে উপযুক্ত। গৃহস্থলি কাজেও সে যে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবে না এটা বিশ্বাস হয় না আইরিসের। লুসিমা পিসি কেবল ঘর গৃহস্থলির কথাই ভাবতে পারেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে একটা ভালোবাসা, রোমান্স আছে সেটা যেন তিনি বুঝতে চান না।
কে জানে তার পিসেমশাই লুসিলা পিসিকে বিয়ে করার সময় এই দিকটা ভেবেছিলেন কি না।
লুসিলার বয়স যখন চল্লিশের কাছাকাছি, তখন তার স্বামী রেভারেন্ড ক্যালেব ড্রেকের বয়স পঞ্চাশ অতিক্রম করেছে। মাত্র দুবছর পিসি তার স্বামীর সঙ্গে সংসার করেছিলেন। একটি পুত্রসন্তান কোলে নিয়ে তিনি বিধবা হন। পরবর্তীকালে ঐ পুত্র ভিক্টর ড্রেক হয়ে ওঠে তার প্রধান চিন্তা এবং দুঃখের কারণ। ক্রমাগত চাপ দিয়ে তার ছেলে তার কাছ থেকে টাকা আদায় করতো। কিন্তু মহিলা কখনো বিরক্তি প্রকাশ করতেন না। বরঞ্চ তার ছেলের নামে কেউ অভিযোগ করলে বা অপবাদ দিলে তিনি ভীষণ রেগে যেতেন। কিছুতেই মেনে নিতেন না। এ ছিলো তার অন্ধ স্নেহের দুর্বলতা। ভিক্টর ছিলো অতি বিশ্বাসী। সেই সুযোগ নিয়ে অনেকে তাকে ঠকিয়েছে, তাকে প্রতারিত করেছে। তার বন্ধুরা তার প্রতি তার মায়ের অন্ধবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাকে দিয়ে অনেক অপ্রিয় কাজ করিয়ে নিতো।
ঠিক এমনি সময়ে আইরিসকে দেখাশোনার জন্য জর্জ তাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। কারণ তখন লুসিলা পিসি আর্থিক দিক থেকে খুব খারাপ হয়ে পড়েছিল। তার পর থেকে একটি বছর এখানে তার সুখেই কেটেছে। বয়স্কা নারী হিসাবে সংসারে সমস্ত কর্তৃত্ব তাঁর হাতে ছিলো। যদি সেই কর্তৃত্ব তার থেকে কম বয়সের মেয়ে এ বাড়িতে এসে কেড়ে নেয় তার হাত থেকে তাহলে তো রুষ্ট হওয়া স্বাভাবিক।
কিন্তু লুসিলা পিসি বোঝেন না, রুথ কেন জর্জকে বিয়ে করতে চায়। রুথ হলো অর্থলোভী। তার ওপর জর্জের মতো অনুগত স্বামী পাবে। আসলে রুথ লেসিং বুদ্ধিমতী। সে আগে থেকে ঘরদোর সাজিয়ে গুছিয়ে জর্জকে বোঝাতে চেয়েছিল যে জর্জের পরিবারে সে কত অপরিহার্য। কিন্তু এ সংসারে একজনের কাছে রুথের চাওয়াটা ধরা পড়ে গেছে।
একদিন একটা কম্বল হাতে নিয়ে লুসিলা পিসি আইরিসের সামনে এসে দাঁড়লেন–আমার হয়েছে এক জ্বালা। আগামী বসন্তের আগে আবার এখানে ফিরে আসবে কিনা সেটা স্পষ্ট ভাবে জানালো না। সেই মতো ন্যাপথলিন দিয়ে রাখতে হবে। নতুবা পোকায় কেটে দেবে।
–আমার মনে হয় তিনি নিজেই জানেন না। আইরিস বললো, ভালোই হলো, আমরা যদি কখনো সখনো এখানে অসি! আমরা আসতে চাইলে বা না চাইলেও তবু এ বাড়িটা এখানে থাকবেই।
-হ্যাঁ, বাছা, সঠিক খবরটা জানতে হবে। সেই মতো ন্যাপথালিন দিয়ে রাখতে হবে। ন্যাপথলিনের গন্ধটা বাপু আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না।
বেশ তো ন্যাপথলিন দিয়ো না।
–যা গরম পড়েছে পোকামাকড়ের উৎপাত হবেই। আর আছে ভীমরুল। গতকাল হকিনস বলছিল।
হকিনস?
আইরিসের মন ছুটে চলে গেল অতীতে। অন্ধকারে সগর্বে পা ফেলতে ফেলতে, হাতের মুঠোর মধ্যেই সায়ানাইড, রোজমেরি–সায়ানাইড, কেন এইসব ভাবনা ঘুরে ফিরে একই জায়গায় এসে জড়ো হয়?
লুসিলা পিসি তখনো বলে চলেছন, গয়নাগুলো কাউকে দিয়ে ব্যাঙ্কে পাঠাবে? লেডি আলেকজান্ডার সেদিন বলেছিলেন আজকাল নাকি চুরি ছিনতাই খুব বেড়ে গেছে। তার মুখ কি কঠিন মনে হলো! হয়তো অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী। আমরা সবাই এখন আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েছি। জর্জের দিকে চোখ মেলে তাকাতে পারি না। মনে হয় ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হবে। আবার ব্যাবসার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন থাকতে হবে। মাঝে মাঝে আমার দিকে যখন তাকায়, মনে হয় ওর মনে কিছু আছে।
আইরিসের শরীরটা কেঁপে উঠতে দেখে মিসেস ড্রেক সোল্লাসে জোরে বলে উঠেন– নিশ্চয়ই তোমার ঠান্ডা লেগেছে, আইরিস।
.
২.২
–তারা এখানে যেন না আসে একথা আমি কি করে ভাবতে পারি।
কথাগুলো অস্বাভাবিক তিক্ততার সঙ্গে উচ্চারিত হলো সান্দ্রা ফ্যারাডের মুখ থেকে। তার স্বামী চকিতে তার দিকে ফিরে তাকালো। সান্দ্রা তো তার মনের কথাগুলোই উচ্চারণ করলো। তাহলে কি সান্দ্রার ভাবনার সঙ্গে তার ভাবনার মিল আছে? তাহলে ও-ও কি অনুভব করছে, পার্কের ওধারে মাইনখানেক দূরে নবাগত প্রতিবেশীদের আগমনে তাদের ফেয়ারহেভেনের সুখ শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে।
আবেগপূর্ণ কণ্ঠে স্টিফেন ফ্যারাডে বলে–ওদের সম্বন্ধে তোমারও যে ঐ ধারণা আমি জানতাম না।
–এখানে লন্ডনের মতো প্রতিবেশীরা নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার করতে পারে না। এখানে কেউ রুক্ষ স্বভাবের কেউবা বন্ধুভাবাপন্ন।
-না, লন্ডনের মতো কেউ আজকাল করতে পারে না। স্টিফেন বলে।