কিন্তু রোজমেরির বন্ধন ছিন্ন করে সে কি করে বেরিয়ে আসবে? ওর কোনো যুক্তির ধার ধারে না। ওকে নিজের পথ থেকে সরাতে একটা মাত্র উপায় আছে, খুন করা। বিষ দিয়ে তাকে চিরদিনের মতো চুপ করিয়ে দেবে। অবশ্য এর জন্য তাকে সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে। এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
এর মধ্যে রোজমেরি ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হলো। ফুলের তোড়া উপহার দিয়ে রোজমেরিকে সৌজন্যতা জানিয়ে এলো।
পরের সপ্তাহে রোজমেরির জন্মদিনের পার্টিতে সস্ত্রীক আমন্ত্রিত হলো। স্টিফেন একান্তে ডেকে তাকে তার মনের কথা জানাতে চাইলো যে ওদের গোপন সম্পর্ক এখানেই শেষ। সম্ভবত রোজমেরি সেটা বুঝে থাকবে। তাই আগে ভাগে বলে দিলো–আজ ওসব আলোচনা নয়। জর্জকে দুদিন পর জানাবো। সে তো আমার স্বামী। তাকে আমি ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলাম। তাই ভাবছি দুদিন পর তাকে আমাদের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দেবো। তারপরেই আমি তোমার হবো, তুমি আমার হবে।
সর্বনাশ! এ অবস্থায় যদি স্টিফেন তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে সান্দ্রা জর্জের মুখ চেয়ে সে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায় তাহলে তো এক বিশ্রী পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে রোজমেরি। কান্নাকাটি করে জর্জকে সে সব কথা জানাবে। স্ত্রীর কথায় সায় দিয়ে সে ডিভোর্সে রাজী হয়ে যাবে। তারপর রোজমেরি যাবে সান্দ্রার কাছে। একজন নারীর মনে তার স্বামী সম্পর্কে একবার সন্দেহ ঢুকলে তার অবসান করা মুশকিল। সে চাইবে না, তার স্বামীকে মিথ্যে ধরে রাখার। অতএব রোজমেরির অনুরোধে সান্দ্রা স্টিফেনকে মুক্তি দিয়ে দেবে।
তাহলে উপায়?
বিষ মেশানো এক গ্লাস শ্যাম্পেন দিয়ে রোজমেরির জীবন শেষ করে দিতে হবে। রোজমেরির শ্যাম্পেনের গ্লাসে পটাশিয়াম সায়ানাইড। টেবিলের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় স্টিফেন দেখলো, সান্দ্রা তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আজ এক বছর পরেও সে দৃষ্টি তার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে।
.
আলেকজান্ডার ফ্যারাডে
১.৫
রোজমেরি বারটনকে আজও মনে পড়ে সান্দ্রা ফ্যারাডের। সেদিনের কথা মনে করতে গিয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে রেস্টুরেন্টে ডাইনিং টেবিল অতিক্রম করতে গিয়ে অদ্ভুত দৃশ্যটা। তার হঠাৎ মনে হয়েছিল, স্টিফেন তাকে লক্ষ্য করছে।
সে কি লক্ষ্য করেছিলো, তার চোখে কি পরিমাণে ঘৃণা, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল?
ওর স্মৃতির মণিকোঠায় আজও রোজমেরি উজ্জ্বল হয়ে বেঁচে আছে। সান্দ্রার মনে এমন কি স্টিফেনের মনেও রোজমেরি আজও জাগ্রত।
সান্দ্রা ভুলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সবই যেন চক্রান্ত। এমন কি ফেয়ারহেভেনও আজ আর প্রশ্নাতীত নয়, বিশেষ করে কাছেই লিটল প্রায়রসে জর্জ বারটনের বাড়ি কিনে বসবাসের পর থেকে।
জর্জ বারটন এক বিচিত্র মানুষ, বলা চলে বোকা। এরকম প্রতিবেশী সান্দ্রার পছন্দ নয়।
স্টিফেন আর সান্দ্রা খুব সুখেই ছিলো। চিরজীবন তারা এইভাবে কাটাতে পারতো। কিন্তু রোজমেরির আবির্ভাবে সব এলোমেলো হয়ে গেল। স্টিফেন পাল্টে গেল। সে যেন সান্দ্রার মধ্যে আগের মতো আর আকর্ষণ অনুভব করে না।
বিয়ের পরেই সান্দ্রা লক্ষ্য করেছিলো, স্টিফেনের মনোভাব। ও যেমন স্টিফেনকে ভালোবাসে, স্টিভেন কিন্তু তেমন করে তাকে ভালোবাসে না। হয়তো সান্দ্রা ভালোবাসার পক্ষে অযোগ্য। সেদিন হঠাৎ এ কথাটা তার মনে উদয় হয়েছিল। অথচ ওর একসময় মনে হয়েছিলো, স্টিফেনের ভালোবাসা ওর কাছে এতই তীব্র এবং আকাঙ্ক্ষিত ছিল যে তার জন্য ও স্বেচ্ছায় প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে, মিথ্যে কথা বলতে পারে, এমনকি প্রয়োজনে কষ্ট স্বীকার করতে পারে। বিনিময়ে সান্দ্রা চেয়েছিলো, ওর সাহচর্য, ওর সহানুভূতি, ওর বুদ্ধিদীপ্ত সাহায্য। এই সমস্ত সুযোগ এবং সুবিধা পাওয়ার জন্যই স্টিফেন বোধ হয় ওকে চেয়েছিলো, ওর হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করার জন্য নয়।
এই সেদিনও সান্দ্রার বিশ্বাস ছিলো, স্টিফেন তাকে ভালোবাসে।
তারপর একদিন ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব হলেন রোজমেরি। সেই থেকে শুরু হলো তার বেদনাদায়ক জীবন।
কিন্তু স্টিফেন কি বুঝতে পারেনি, রোজমেরির আবির্ভাবে সান্দ্রার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে? সে প্রথম দিনই সেন্ট মারটিজে রোজমেরির সঙ্গে স্টিফেনের প্রথম আলাপের সময় যে ভাবে তাকায়, ঠিক সেই রকম যেন, সেইদিনই সান্দ্রার বুঝতে দেরি হয় না, ভদ্রমহিলা স্টিফেনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে চায়।
তারপর থেকেই তার বুকের মধ্যে জ্বালা যন্ত্রণা অনুভব করে। তার মন বিষিয়ে উঠেছে তার পরের দিন থেকে। কিন্তু সমস্ত মুখ বুজে সহ্য করে গেছে। নিজের বংশমর্যাদা আভিজাত্য এবং মনের প্রসন্নতা দিয়েও উপলব্ধি করেছে এবং সঙ্গে সঙ্গে স্থির করেছে, এইসব মানসিক যন্ত্রণার কথা স্টিফেনকে একটুও বুঝতে দেবে না। মনের সঙ্গে সমানে লড়াই করতে করতে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে, রাতের ঘুমও উধাও হয়েছে। সে কেন রাতের পর রাত জেগে কাটাচ্ছে, সে সব খোঁজ কখনো স্টিফেন নেয়নি। তার অত সময় কোথায়? তখন সে রোজমেরিকে নিয়ে ব্যস্ত। সেই জ্বালা-যন্ত্রণা ভুলে থাকার জন্য উত্তেজক ট্যাবলেট খেয়েছে, তবু স্টিফেনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ কখনো করেনি।
তবে সে একটা সত্যি উপলব্ধি করেছে স্টিফেনকে ত্যাগ করার ইচ্ছে তার নেই। অপরদিকে স্টিফেন নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য তাকে ছেড়ে কোনোদিন যাবে না। ওর আশা রোজমেরির ওপর মোহ একদিন লোপ পাবে, তার শুভবুদ্ধি জেগে উঠবে।