মেয়েটির চোখে মুখে লজ্জার আভা তখনো লেগে আছে।
–আমি আলেকজান্ডার হেইলি।
সেই থেকে তারা ঐ পার্কে অনেকবার মিলিত হয়েছে। সে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা তাকে জানায়। কখনো রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে। ওর কথা শুনে স্টিফেনের ধারণা হয়, মেয়েটি ভীষণ বুদ্ধিমতী, যথেষ্ট জ্ঞান আছে। সেই সঙ্গে সহানুভূতিশীলও বটে।
লেডি কিডারমিনস্টারের মনটা পরখ করার জন্য একদিন শান্তস্বরে সান্দ্রা বলে–আচ্ছা, স্টিফেন ফ্যারাডেকে তোমার কি মনে হয়?
স্টিফেন ফ্যারাডে?
–হ্যাঁ, সেদিন সে ত তোমার পার্টিতে এসেছিল। পরে কয়েকবার তার সঙ্গে আমি দেখা করেছি।
–দারুণ মেধাবী যুবক। প্রখর বুদ্ধি। জনসাধারণের সঙ্গে তার খুব বেশি পরিচয় নেই। তবে একদিন সে নাম করবেই।
সেই থেকে স্টিফেন নিজেকে কিডারমিনস্টার পরিবারের মধ্যে খুব সহজেই মানিয়ে নিলো। সবাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলো।
মাস দুই পরে স্টিফেন নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করার জন্য সারপেনটাইনে সান্দ্রার সঙ্গে দেখা করলো।
সান্দ্রা, তোমাকে আমি ভালোবাসি। স্টিফেন বলতে থাকে। তোমাকে আমি বিয়ে করতে চাই। আমাকে তুমি তোমার জীবনসঙ্গিনী করে লজ্জা পাবে না।
-না না, লজ্জা পাবো কেন? আমিও তো তোমার কথা ভাবি। তুমি বুঝতে পারো না?
-পারি, কিন্তু আমি নিশ্চিত হতে পারি না। তোমাকে প্রথম যেদিন দেখি সেদিনই তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি।
–আমিও তোমাকে ঐ দিন ভালোবেসে ফেলি।
সান্দ্রার পরিবারের সকলে যখন জানতে পারলো যে সে স্টিফেন ফ্যারাডেকে বিয়ে করতে চলেছে। তখন সবাই প্রতিবাদ করে উঠলো। কি তার পরিচয়? ওর সম্বন্ধে সান্দ্রা কতটুকুই বা জানে?
লর্ড কিডারমিনস্টার জানতেন তার মেয়ের স্বভাবের কথা। তার মেয়ে যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে, অনমনীয় মনোভাব তার। যদি সে মনে করে স্টিফেনকে বিয়ে করবে তাহলে তাকে কেউ সেই ইচ্ছে থেকে বিরত করাতে পারবে না।
-সত্যি, ছেলেটার মধ্যে প্রতিভা আছে। সুযোগ পেলে উন্নতি করতে পারবে। আমরা হয়তো এই যুবকটিকে আমাদের কাজে লাগাতে পারি।
লেডি কিডারমিনস্টারের মত কিন্তু অন্য। তার মেয়ের সঙ্গে স্টিফেন যে একেবারেই খাপ খাওয়াতে পারবে, সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। তার অন্য মেয়েদের চেয়ে সান্দ্রার আকর্ষণ নিশ্চয়ই কম, তাছাড়া লাজুক মেয়ে। কিন্তু যুবকটির মধ্যে ভবিষ্যত অছে, সেকথা সকলে ভেবেই–
লেডি কিডারমিনস্টার একটি শর্তে রাজী হলেন এই বিয়েতে, যে তার হয়ে কাউকে প্রভাব খাটাতে হবে।
অতএব আড়ম্বরের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল আলোকজান্ডার ক্যাথেলিন হেইলির সঙ্গে স্টিফেন লিওনার্ড ফ্যারাডের। ইটালিতে তারা মধুচন্দ্রিমা কাটিয়ে এলো। ওয়েস্ট-মিনিস্টারে ছোটোখাটো একটা সুন্দর বাড়িতে ফিরে এলো। তাদের বিবাহিত জীবন সুখেই কাটতে লাগলো। স্টিফেন পার্লামেন্টের জীবনে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করলো আর সান্দ্রা তার আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেললো তার মনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়ে। তার ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন ভেবে স্টিফেন নিজেই এক একসময় অবাক হয়ে যেতো।
প্রকৃত জীবনসঙ্গিনী হিসাবে সান্দ্রা যথার্থ। প্রতিটি কাজে ওর বুদ্ধিদীপ্ত ছাপ স্পষ্ট। স্টিফেনের সঙ্গ সান্দ্রার আদর্শ বলে মনে হয়। তাদের দুজনের ভালোবাসা যেন একই খাতে প্রবাহিত। মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে সাফল্যকে হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে নিয়েছে।
সাফল্যের আতিশয্যে স্টিফেন তখন আত্মহারা। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সে পনেরো দিনের জন্য যায় মরটিজে। হোটেল লাউঞ্জ অতিক্রম করতে গিয়েই রোজমেরি বারটনকে দেখতে পায়।
সেই মুহূর্তটুকু তার যে কি হয়েছিল সেই অনুভূতি কোনদিন সে উপলব্ধি করতে পারেনি। কাব্য করে বলা যায়, সেই মুহূর্তটি যেন এক বিদ্যুতের ঝলকানি। স্পর্শে আঁকুনি কিন্তু তার রেশ বহুদূর বিস্তৃত। সে অনুভব করে রোজমেরির প্রেমে পড়ে গেছে সে, সে প্রেমে আছে এক বেপরোয়া উন্মাদনা। তবে একথা ঠিক স্টিফেন কখনোই ভাবপ্রবণ নয়। ভালোবাসা হলো তার কাছে সীমাহীন, বলগাহীন, অনন্ত তত্ত্বহীন প্রেম।
তবে কি সে সান্দ্রাকে ভালোবাসে না। নিশ্চয়ই ভালোবাসে। কিন্তু সান্দ্রার বাবা যদি ধনী না হতেন তাহলে তাকে বিয়ে করার কথা ভাবত না। আজও সান্দ্রাকে সে ভালোবাসে, তার প্রতি আছে তার মমত্ববোধ, আর কৃতজ্ঞতাবোধ। তার সঙ্গ সাহচর্যে সে আজ সাফল্যের শিখরে পৌঁছতে পেরেছে।
কিন্তু রোজমেরির প্রেমে সে তখন হাবুডুবু খাচ্ছে, পাগল করে দেওয়া রূপ, সোনালি চুল, নীল রঙের চোখের দৃষ্টি তাকে করে দিলো দিশেহারা। ঘুম-খাওয়া বিদায় নিলো তার কাছ থেকে। সেদিন সন্ধ্যায় সান্দ্রার সঙ্গে সে নাচলো বটে, কিন্তু সেই নাচে ছিল না উন্মাদনা, কেমন বিমর্ষ ভাব। কিন্তু রোজমেরি জানে না স্টিফেনের আবির্ভাবটা তার মনে ঠিক কি রকম আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
বারটনরা এক সপ্তাহ আগে সেন্ট মরটিজ ছেড়ে চলে গেছে। তাদের আরো সাতদিন সেখানে থাকার কথা। কিন্তু স্টিফেনের মন বসলো না। স্টিফেন লন্ডন ফিরে এলো। সান্দ্রা কোনো আপত্তি করলো না।
লন্ডনে ফেরার পনেরো দিনের মধ্যে রোজমেরির সঙ্গে তার প্রেম হলো। মাত্র ছমাস তাদের ভালোবাসা স্থায়ী হয়েছিল। সেই ছমাস স্টিফেন কিন্তু কাজে একটুও গাফিলতি দেয়নি। সে তার রুটিনমাফিক কাজ করে গেছে। নির্বাচন এলাকা পরিদর্শন করেছে, পার্লামেন্টে রাজনীতি বিষয়ক প্রশ্ন নিয়ে ঝড় তুলেছে। বিভিন্ন জনসভায় উপস্থিত থেকেছে, সান্দ্রার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করেছে, এরই ফাঁকে রোজমেরির সঙ্গে দেখা করেছে।