আমাকে? এমন কেউ আছে যে আমার সম্পর্কে, এসব উদ্ভট কথা বিশ্বাস করতো?–লর্ড হুইটফিল্ডের কণ্ঠস্বরে বিস্ময়, ব্যথা-একীভূত।
ব্রিজেট বললো–অন্ততঃ আমি করতাম না গর্ডন, কখনো আমি তোমার সম্পর্কে একথা মেনে নিতে পারতাম না।
কথা শেষ করেই লর্ড হুইটফিল্ড বাইরে বেরিয়ে গেলো।
লিউক বললো–ব্রিজেট, এবার তুমি বলো, ওয়েনফ্লিটকে তুমি কেন সন্দেহ করলে?
ব্রিজেট ব্যাখ্যা করে–আমি প্রথমে সন্দেহ করলাম, যখন তুমি বললে যে, গর্ডন খুনী। কথাটা আমি বিশ্বাস করিনি কারণ ওর বাইরেটা আর ভেতরটা–দুটোই আমার জানা। এটা স্বীকার করি যে, ও আড়ম্বরশালী, মোটাবুদ্ধি সম্পন্ন ও আত্মকেন্দ্রিক লোক; কিন্তু ওর মন ফুলের মতো নরম আর ও অস্বাভাবিক রকম দয়ালু। একটা শুয়োপোকা মারতে পর্যন্ত ওর হাত ওঠে না। শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম যে ওর পক্ষে ক্যানারী পাখির ঘাড় মটকে মেরে ফেলার কথা সবটাই মিথ্যে-ভুল। দ্বিতীয়তঃ গর্ডন একদিন গল্পচ্ছলে আমাকে বলেছিলো যে, ও-ই ওয়েনফ্লিটকে বিদায় করেছিলো। অথচ তোমার কাছে শুনলাম ঠিক তার উল্টোটা। কিন্তু ক্যানারীর গল্প কিছুতেই সত্যি হতে পারে না, অমন একটা কাজ গর্ডনের পক্ষে একেবারে অসম্ভব। জানো? ও শিকারে পর্যন্ত যায় না, কারণ রক্ত দেখলেই ওর শরীর গুলিয়ে ওঠে।
সুতরাং একথা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম যে, গল্পের ওই অংশটুকু পুরোপুরি মিথ্যে।
এরপর মনে প্রশ্ন জাগলো, আর কী কী ও বলে থাকতে পারে? একটা ব্যাপার সহজেই বোঝা যায় যে মহিলা অত্যন্ত অহঙ্কারী; কেউ ওকে প্রত্যাখ্যান করেছে–এ চিন্তা ওর গর্ববোধকে প্রচণ্ড আঘাত করবেই; এবং তার ফলে রেগে গিয়ে প্রতিহিংসা নেবার চেষ্টা করাটা বিচিত্র নয়–বিশেষ করে লর্ড হুইটফিল্ড আবার যখন সামাজিক ও আর্থিক ক্ষেত্রেই উত্তর জীবনে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করলো। তাই গর্ডনের মতো একজন মোটাবুদ্ধির মানুষের কাঁধে এক মিথ্যে বোঝা চাপিয়ে দেওয়া বা মিথ্যে জাল জড়িয়ে ফেলা ওয়েনফ্লিটের মতো মেয়েমানুষের পক্ষে অতি সহজ। আমার মন বললো–আপাতঃ দৃষ্টিতে যতই কঠিন হোক, এমন যদি হয়ে থাকে যে, এই মহিলাই সবগুলো খুন এমন ফন্দি করে করেছে, যাতে করে গর্ডনকে দিয়ে সহজেই বিশ্বাস করানো যায় যে, পর-পর সবকটা মৃত্যুই এক ঐশ্বরিক অমোঘ বিধান?–ওর পক্ষে গর্ডনকে একথা বিশ্বাস করানো মোটেই দুঃসাধ্য নয়। তোমাকে আমি এর আগেই বলেছি যে, গর্ডন সব কিছুই বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করে। তারপরে ভাবলাম–ওর পক্ষে কি এতগুলো খুন করার সুযোগ ছিলো?–অনুধাবন করে দেখলাম–হ্যাঁ ছিলো। একজন মাতালকে একটা ছোট্ট ধাক্কা দেওয়া, একটা বাচ্চা ছেলেকে জানলা থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া
ওর পক্ষে কঠিন কিছু নয়। আমি গিবস্ তো ওর বাড়িতেই ছিলো। মিসেস হর্টনের অসুস্থতার সময়ে ও প্রতিদিন ওখানে যাতায়াত করতো। ডাঃ আম্বলবির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিছু কঠিন ছিলো। এটা চিন্তা করে বের করতে পারিনি যে, ও ওয়াঙ্কিপু-র কানের ঘা থেকে ব্যাণ্ডেজ বাঁধবার কাপড় দূষিত-করে ডাঃ আম্বলবির হাতে বেঁধে দিয়েছিলো। মিস পিঙ্কারটনের মৃত্যুটা আরো রহস্যময় মনে হয়েছিলো। কারণ ওর মতো একজন মহিলা ড্রাইভারের পোশাক পরে একটা রোলস্ চালাবে–একথা স্বপ্নেরও অগোচর। কিন্তু পর মুহূর্তে মনে হলো–নাঃ তার তো দরকার নেই। ওর পুরানো পদ্ধতি অবলম্বন করে অতি সহজেই ভীড়ের মধ্যে আত্মগোপন করে একটা ছোট্ট ধাক্কা দিয়েই তো কাজ হাসিল করা যায়–এবং হয়েছিলোও তাই। গাড়িটা পালিয়ে যাওয়ার আরো একটা সুযোগের পেয়ে গেল; পাশের এক মহিলাকে ও একটা নম্বর বললো এবং সেই নম্বর লর্ড হুইটফিল্ডের রোলসের নম্বর।
যদিও একথা সত্যি, যে ব্যাখ্যা তোমাদের দিলাম, তার এতটা নিখুঁত রূপরেখা সেই সময়ে আমরা মাথায় ছিলো না। তবে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, গর্ডন খুনী নয়। তাই যদি হয়, তাহলে এতগুলো খুন কে করলো? উত্তরটাও সহজেই মাথায় এলো। এমন একটা কেউ, যে গর্ডনকে ঘৃণা করে। কে গর্ডনকে ঘৃণা করতে পারে? হনরিয়া ওয়েনফ্লিট ছাড়া আর কে-ই বা হতে পারে?
একটা ব্যাপার জানতাম যে মিস পিঙ্কারটনের সন্দেহ অমূলক নয়–নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে সেকথা মহিলা প্রমাণ করেছিলেন। এই জন্যই তোমাকে বলতে বলেছিলাম যে, মিস পিঙ্কারটন ঠিক কী কী বলেছিলেন। তোমার কাছ থেকে শুনে যখন আবিষ্কার করলাম যে মিস পিঙ্কারটন একবারও কোনো পুরুষমানুষের কথা বলেননি, তখনই বুঝে গেলাম যে, আমার চিন্তাধারার মধ্যে কোনো অসঙ্গতি নেই এবং সে কারণেই সাগ্রহে মিস ওয়েনফ্লিটের নিমন্ত্রণে আমি রাজী হয়ে গেলাম।
লিউক বেশ রাগতস্বরে বললো–আমাকে এর বিন্দুবিসর্গ না বলে?
কী করে তোমায় বলি বলো? তুমি যে একেবারে ধরে বসেছিলে যে গর্ডনই হত্যাকারী; আর সে জায়গায় আমি তো তখনো অনুমানের সাগরে সাঁতার কাটছি! ভাবতেও পারিনি যে আমার কোনো বিপদ আসতে পারে-বরঞ্চ ভেবেছিলাম যে, হাতে আমার প্রচুর সময়…,–বলতে বলতে ব্রিজেট শিউরে ওঠে–উঃ, লিউক! সে কী জান্তব দৃশ্য!…ওর সেই অস্বাভাবিক চোখ আর খুক খুক করে অমানুষিক হাসি।
লিউকও একটু কেঁপে ওঠে সেই দৃশ্যের বীভৎসতায়।
আমিও কোনোদিন ভুলতে পারবো না যে, কী দারুণ এক মুহূর্তে আমি ওখানে গিয়ে পড়েছিলাম।