মেয়েটিকে ঠেলে দিয়ে লিউক প্রায় ছুটে হুড়মুড় করে বসবার ঘরে গিয়ে ঢুকলো আর এমিলি দৌড়ে ওপরের তলায় গিয়েই একছুটে নেমে এসে প্রায় দম-ফুরোনো গলায় বললো–সেই নতুন মেম সাহেবও বেরিয়ে গেছেন।
মেয়েটির কাঁধ দুটো ধরে ঝাঁকিয়ে লিউক বললো–কোনো দিকে গেছে? কোথায় গেছে?
ঢোক গিলে মেয়েটি বললো–আমি তো সব সময়ে রান্নাঘরে ছিলাম; সামনের দরজা দিয়ে গেলে আমি নিশ্চয়ই দেখতে পেতাম। ওঁরা পেছনের দরজা দিয়েই গেছেন।
প্রায় ছুটে ছোট একটা বাগান পেরিয়ে লিউক রাস্তায় এসে পড়লো। ওর সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটিও সদর দরজা পর্যন্ত ছুটে আসে। একজন লোক কিছুটা দূরে বড় একটা কাঁচি দিয়ে গাছের মাথা হেঁটে দিচ্ছিলো; লিউক এগিয়ে গিয়ে লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো যে, সে দুজন মহিলাকে যেতে দেখেছে কিনা।
লোকটি বললো–দুজন মহিলা? হ্যাঁ, বেশ কিছুক্ষণ আগেই গেছে, আমি তখন ওই বেড়ার নিচে বসে খাচ্ছিলাম–তবে, ওঁরা আমায় দেখেছেন বলে মনে হয় না।
কোনো দিকে গেছেন?
লোকটা লিউকের দিকে তাকিয়ে বললো–ওই মাঠের ভেতর দিয়ে ওঁদের যেতে দেখেছি; তার পরে ওঁরা কোথায় গেছেন লক্ষ্য করিনি।
লোকটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবার ও রীতিমতো ছুটতে আরম্ভ করে।বড্ড দেরি হয়ে গেছে, বড্ড দেরি হয়ে গেছে, যেভাবেই হোক ওদের ধরতে হবে।-ও কি পাগল হয়ে গেল কি?
ও পর পর দুটো মাঠ এভাবে পেরিয়ে গেল। সামনে একটা ছোটো পাড়গেয়ে মেঠো পথ। কোনো দিকে এবারে যাবে বুঝতে না পেরে ও একটু দাঁড়ায়, আর তখনই শুনতে পায়, সেই আকুল আর্তনাদ–লিউক, লিউক…বাঁ-চা-ও!
লিউক দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যেদিক থেকে আওয়াজ আসছিলো, সেদিকে ছুটতে আরম্ভ করলো। আরও কিছুটা এগোতেই একটা হুটোপাটি আর তার সঙ্গে একটা গোঙানীর আওয়াজ শুনতে পেলো।
বনবাদাড় পেরিয়ে প্রচণ্ড বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে ও এক উন্মত্ত মহিলার শক্ত বেড়ির মত বসা হাত দুখানা টেনে ধরতেই তার সে কী ভীষণ চীৎকার। মহিলার সমস্ত শরীর তখন থর থক্ করে কাঁপছে, মুখ দিয়ে সাবানের ফেনার মতো গাঁজলা বেরোচ্ছে। সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁকুনি দেওয়াতে মহিলা শেষ পর্যন্ত লিউকের হাতের মধ্যেই এলিয়ে পড়লেন।
***
নতুন দিগন্ত
কী যে হচ্ছে, আমি তার কিছুই বুঝতে পারছি না।-গাম্ভীর্য বজায় রাখার চেষ্টা সত্ত্বেও লর্ড হুইটফিল্ড ভেতরে অস্থির, হতাশ ভাবটা গোপন রাখতে পারলেন না। হুইটফিল্ড ঘটনারাশির আকস্মিকতায় একেবারে হতচকিত এবং হতভম্ব।
ব্যাটল অবস্থাটা আন্দাজ করতে পেরে শান্ত স্বরে বললেন-আমরা সমস্ত ব্যাপারটা অনুসন্ধান করে দেখেছি তাতে দেখা যাচ্ছে যে, ওয়েনফ্লিট পরিবারের প্রায় সকলের মধ্যেই একটা মানসিক বৈকল্যের লক্ষ্মণ প্রথম থেকেই ছিলো; তার ওপর এই মহিলার ছিলো গগনচুম্বি উচ্চাকাঙ্ক্ষা। প্রথমতঃ কোনো দিকেই সে উচ্চাশা ফলপ্রদ হয়নি, তার ওপর ভালোবাসার ক্ষেত্রেও পেলো এক প্রচণ্ড আঘাতআবার বললেন–শুনলাম, আপনিই ওকে সেই আঘাত দিয়েছিলেন।
এই আঘাত কথাটা আমার মোটেই ভালো লাগছে না।–আরো গম্ভীর হবার চেষ্টা করে। লর্ড হুইটফিল্ড বললেন।
তৎক্ষণাৎ কথাটা সংশোধন করে সুপারিনটেন্টে ব্যাট বললেন–অর্থাৎ, আপনিই বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছিলেন?
তা–তা দিয়েছিলাম।
ব্রিজেট বললা–কেন দিয়েছিলে আমাদের বলো গর্ডন।
লর্ড হুইটফিল্ড বললেন–ঠিক আছে, যদি একান্তই শুনতে চাও বলছি। হনরিয়ার একটা ক্যানারী পাখি ছিলো–ও খুব ভালোবাসতো পাখিটাকে। পাখিটার একটা অভ্যাস ছিলো হনরিয়ার ঠোঁট থেকে চিনির টুকরো টুকরে তুলে নেওয়া। একদিন ঐভাবে নিতে গিয়ে পাখিটা হনরিয়ার ঠোঁট কামড়ে দেয় আর তাতে রেগে গিয়ে ও পাখিটার ঘাড় মটকে ওটাকে মেরে ফেললো। সেই দৃশ্য দেখার পর ওর ওপর আমার ধারণা গেল পান্টে। কিছুতেই আর আগে মন নিয়ে ওকে দেখতে পারলাম না এবং ওকেও সেই কথাই বললাম যে, আমরা বোধহয় পরস্পর এতদিন ভুল করেছি।
ব্যাটল বললেন–সেই থেকে আরম্ভ। ও নিজেই মিস কনওয়েকে বলেছে যে, সেই থেকে ওর লক্ষ্য ছিলো প্রতিশোধ নেওয়া–ওর বুদ্ধিবৃত্তি সবই এই দিকেই নিয়োগ করেছিলো।
একটা খুনী হিসেবে আমাকে ধরিয়ে দেবার জন্য? এ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না।
কিন্তু গর্ডন, এ কথা সত্যি। তুমি নিজেই তো আশ্চর্য হয়েছিলে দেখে, যে-লোক তোমার বিরুদ্ধাচরণ করতো, অচিরেই সে মারা যেতো।–ব্রিজেট বললো।
তার একটা অন্য গূঢ় কারণ। তুমি একথাটা বোঝবার চেষ্টা করো গর্ডন, টমি পিয়ার্সকে জানলা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া বা অন্যান্য যারা একের পর এক খুন হয়েছে, তার পেছনে নিয়তির কোনো হাত নেই–সবই হনরিয়া ওয়েনফ্লিটের কাণ্ডকারখানা।
লর্ড হুইটফিল্ড অস্বীকার করে বলেন–আমার কাছে সবই কেমন একটা ধাঁধার মতো লাগছে।
আপনিই তো বললেন যে আজই কে একজন আপনাকে ফোন করেছিলো?–প্রশ্ন করেন ব্যাট।
হ্যাঁ, বারোটা নাগাদ। বললো। আমি যেন তক্ষুণি শর জঙ্গলে যাই। ব্রিজেট তুমি না-কি খুব জরুরী বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলে?
ব্যাটল বলেন–তাহলেই দেখুন, ওখানে একবার গেলে আর দেখতে হতো না; যাকে বলে, একেবারে স-প্রমাণ ধরা পড়ে যেতেন। ভেবে দেখুন, মিস কনওয়ের ঘাড় থেকে মাথা কাটা, পাশেই পড়ে আছে আপনার ছুরি; ছুরির হাতলে আপনার আঙুলের পরিষ্কার ছাপ–সর্বোপরি যে সময়ে খুনটা হয়েছে সেই সময়েই আপনাকে ওই অঞ্চলে দেখা গেছে। দাঁড়াবার মতো একটুকরো মাটিও থাকতো না আপনার পায়ের নিচে-যে কোনো জুরি আপনাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতো।