প্রথম কটা বছর শুধু ভাবতাম কী করি…। প্রথমে ঠিক করেছিলাম ওকেই খুন করবো এবং তখন থেকেই লাইব্রেরিতে বসে সারাদিন ধরে সবার চোখ এড়িয়ে অপরাধতত্ত্বের বই পড়তে আরম্ভ করলাম। আমার সেই পড়াশোনার ফল কয়েকবারই হাতে-নাতে পেয়েছি–যেমন, অ্যামির বিছানার পাশে বোতল পাল্টাপাল্টি করে রেখে ওর ঘরের তালা ছোট্ট একটা কাঠি দিয়ে বাইরে থেকে বন্ধ করা। ওঃ, সেই মেয়েটার কী নাক ডাকিয়ে ঘুম। অত্যন্ত বিরক্তিকর।
ভদ্রমহিলা একটু দম নেন, তারপর বলেন–কী যেন বলেছিলাম?
ব্রিজেটের চরিত্রের একটা বড় গুণ–যা দিয়ে লর্ড হুইটফিল্ডকে ও খুশী করতে পেরেছিলো, তা হচ্ছে অন্যের কথা নিঃশব্দে সোনার মত ধৈৰ্য্য এবং এক্ষেত্রেও সেই একই গুণ কাজে এলো।
যদিও ওয়েনফ্লিট একজন উন্মাদিনী, খুনী, কিন্তু একথা সত্যি যে, তারও একজন নীরব শ্রোতার বড্ড প্রয়োজন। মিস ওয়েনফ্লিটকে কথা বলাবার জন্য যতটুকু দরকার ব্রিজেট মেপে ঠিক ততটুকু বলে-আপনি বলেছিলেন যে প্রথমে আপনি গর্ডনকে খুন করবেন ভেবেছিলেন।
হ্যাঁ, মনে করেছিলাম; কিন্তু সেটা আমার ভালো লাগলো না, একেবারেই গতানুগতিক মনে হলো। ওকে এমন শাস্তি দেওয়া ঠিক করলাম, যাতে ও খুনী হিসেবে চিহ্নিত হয়, যাতে নিজে নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও পরস্পর কতগুলো খুনের দায় ওর ঘাড়ে চাপে। আমার অপরাধের জন্য ও ফাঁসির দড়িতে ঝোলে অথবা ও পাগল হয়ে যায়। একটা পাগল হিসেবে কয়েদখানায় থাকে…এটা যদি হয়, তাহলেই সবচেয়ে ভালো।
ভদ্রমহিলা খুক খুক করে হেসে ওঠেন। এ হাসি বড়ই মর্মবিদারক হাসি!
তোমাকে একটু আগেই বলেছি যে আমি অপরাধতত্ত্বের ওপর বেশ কিছু বই পড়েছি। ওখান থেকেই আমি ঠিক করলাম যে, কাকে খুন করা দরকার। প্রথম দিকে লোকে ওকে খুব একটা সন্দেহ করুক–এ আমি চাইনি। একটা ব্যাপার আমি লক্ষ্য করেছি যে খুন করে আমি আনন্দ পেতাম। সেই খুঁতখুঁতে মহিলা লেডি হর্টন–ভদ্রমহিলা এমনিতে আমাকে পছন্দ করতেন, দরকারে সাহায্যও করতেন; কিন্তু একদিন আমার সম্পর্কে বলতে গিয়ে বুড়ী বলে উল্লেখ করলেন। এর ঠিক কিছুদিন পরেই গর্ডনের সঙ্গেও ভদ্রমহিলার ঝগড়া হলো–আমার মনটা একেবারে নেচে উঠলো। ভাবলাম একই ঢিলে দুই পাখি মারবো। কী মজাটাই না করলাম। ওঁর বিছানার পাশে বসে ওঁর চায়ে আমি নিজেই বিষ মেশালাম, আর আমিই আবার বাইরে এসে নার্সদের বললাম যে, লর্ড হুইটফিল্ডের পাঠানো আঙুর মিসেস হর্টনের মুখে তেতো লেগেছে। কিন্তু এ কথার প্রতিবাদ করার জন্য সেই মহিলা আর বেঁচে রইলেন না।
তারপর একে একে অন্যদের। যখনই শুনতাম যে গর্ডন কারও ওপর রেগে গেছে, তখনই একটা করে দুর্ঘটনা ঘটানো এমন কিছু কঠিন নয়। আর ও এমন বোকা–এমন নিরেট মূর্খ। আমিই ওকে বিশ্বাস করিয়েছিলাম যে, ও এমনই একজন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ওর বিরুদ্ধাচরণ করলেই তার শাস্তি অনিবার্য। অতি সহজেই ও বিশ্বাস করেছিলো। আহা রে, আমার প্রাণের গর্ডন। সব কিছুতেই ওর অনড়, অটল বিশ্বাস–এমনই মোটা বুদ্ধি ওর!
মনে পড়ে ব্রিজেটের, সেও একদিন লিউককে বলেছিলা–গর্ডন?–সে সবই বিশ্বাস করে।–সহজ?–সত্যিই সহজ। বাগাড়ম্বর সম্পন্ন মূর্খ গর্ডন।
কিন্তু না। থামতে দিলে চলবে না–ওর আরও অনেক শোনার আছে।
ব্রিজেট বলে কিন্তু এসব আপনি করলেন কী করে? আমি কিছুতেই বুঝতে উঠতে পারছি না।
এতো সহজ ব্যাপার। অ্যামিকে যখনই ওর ম্যানর থেকে তাড়িয়ে দিলো, আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে রেখে দিলাম। হ্যাট পেইন্ট দিয়ে কাজ হাসিল করার বুদ্ধিটা আমার ভালোই খেটেছিলো; তার ওপর বাইরে থেকে দরজায় তালা বন্ধ করার কৌশলটাও আরও কাজে দিলো। সর্বোপরি, আমার সুবিধে ছিলো যে, খুন করার পেছনে আমার কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না। উদ্দেশ্য ছাড়া যে কেউ খুন করতে পারে, একথা চিন্তাই করা যায় না। কার্টারের ক্ষেত্রেও খুব সহজেই কাজ হাসিল করা গেছে। চারিদিকে কুয়াশায় আচ্ছন্ন, অস্পষ্ট; তার মধ্য দিয়েও টলতে টলতে আসছিলো। পুলের ওপর অপেক্ষা করছিলাম, ওখান থেকে দিলাম এক ধাক্কা– বিদুৎগতিতে–ব্যাস! রোগাপটকা হলেও আমার গায়ে বেশ জোর আছে।
তারপর ব্রিজেটের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন–জানো, লোকজন যে সত্যিই এতো বোকা একথা আমি আগে জানতাম না।
ব্রিজেট বলে-ডাঃ আম্বলবির ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই খুব অসুবিধে হয়েছিলো?
তা হয়েছিলো। না হবার সম্ভাবনাই ছিলো বেশি; কিন্তু গর্ডন ওয়েলারম্যান ক্রেইৎস গবেষণাগারে গিয়েছিলো–এই কথা ও যখন সবার কাছে বলে বেড়াতে আরম্ভ করলো তখনই একটা বুদ্ধি আমার মাথায় এলো। ভাবলাম এটা কাজে লাগানো যায় কিনা–সেই অনুযায়ী ওয়াঙ্কিপু-র কানের ঘা-টা দেখাবার জন্য একদিন ডাঃ আম্বলবিকে ডাকলাম। উনি যখন ওয়াঙ্কিপু-র কানে ব্যাণ্ডেজ বাঁধছিলেন, তখন আমার হাতের কাঁচি দিয়ে ডাঃ আম্বলবির হাতটা খানিকটা চিরে দিলাম–যেন হাত ফসকে লেগে গেছে। এমন ভাব করলাম যেন লজ্জায় দুঃখে একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে গেছি. একটা ব্যাণ্ডেজ এনে ওঁর কাটা জায়গাটা বেঁধে দিলাম। আগে থেকেই ব্যাণ্ডেজের কাপড়ে ওয়াঙ্কিপু-র কানের পুঁজ-রক্ত খানিকটা মিশিয়ে রেখেছিলাম। ফলও ফললো।
ল্যাভিনিয়া পিঙ্কারটন। ও টের পেয়েছিলো। টমিকে সেই অবস্থায় ওই প্রথম দেখতে পায়। তারপর গর্ডন আর আম্বলবির মধ্যে যেদিন কথা কাটাকাটি হলো, সেদিন আমি আম্বলবির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম–তাও ওর নজরে পড়লো, দেখলাম, ও আমাকে একদৃষ্টে-একমনে লক্ষ্য করছে। তখনই বুঝে গেলাম ও জেনে গেছে। একথাও জানতাম যে, ও কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না; তবে আবার এ কথাও মনে হলো যে, কেউ যদি–বিশেষ করে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের লোকেরা ওর কথা বিশ্বাস করে তাহলেই ঝামেলা। আমি জানতাম সেদিন ও কোথায় যাচ্ছিলো। একই ট্রেনের অন্য একটা কামরায় আমি ওকে অনুসরণ করলাম। তার পরের ব্যাপারটা খুব সহজেই ঘটলো। হোয়াইট হলের সামনে রাস্তা পেরোবার জন্য ও দাঁড়ালো। ওর চোখ এড়িয়ে ঠিক ওর পেছনে আমিও গিয়ে দাঁড়ালাম। যেই একটা বড় গাড়ি এলো, গায়ের জোরে ভীড়ের মধ্য থেকে দিলাম একটা প্রচণ্ড ধাক্কা। আমার শরীরে প্রচণ্ড শক্তি। ও একেবারে সামনের চাকার তলায় পিষে গেলো। আমার পাশের মহিলাকে বললাম যে আমি গাড়ির নম্বর দেখতে পেয়েছি, এবং গর্ডনের গাড়ির নম্বরটা বললাম। ধরেই নিলাম যে ওই মহিলা পুলিশকে এই নম্বরই বলবে।