স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের সেই সুপারিনটেটে তো?
হা। ভদ্রলোক কতকগুলো বিষয় নিয়ে এক্ষুনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান।
আমার দিক থেকে কোনো অসুবিধে নেই; তবে তুমি যখন আসবে, আমার জিনিষপত্রগুলো সঙ্গে নিয়ে এসো, আর তখনই শোনা যাবে ভদ্রলোকের সঙ্গে তোমার কী কথাবার্তা হলো।
ঠিক আছে, তাহলে তা-ই ঠিক রইলো–ছাড়ছি।
আচ্ছা।
টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে রেখে ব্রিজেট মিস ওয়েনফ্লিটকে ওদের দুজনের কথাবার্তার আনুপূর্বিক বর্ণনা দেয়।
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন,–কিছু পুরানো কাপড়চোপড় নিয়ে কাছেই এক মহিলার বাড়ি যাচ্ছি। যাবে নাকি আমার সঙ্গে? খাওয়ার আগেই আমরা ফিরে আসবো।
ব্রিজেট রাজী হয়ে যায়।
পেছনের দরজা দিয়ে ওরা বেরিয়ে যায়। মিস ওয়েনফ্লিটের হাতে দস্তানা এবং মাথায় একটা ঘাসের টুপি।
নিজের মনে ব্রিজেট বললো–আমরা যেন সেজেগুজে একেবারে বণ্ড স্ট্রীটে যাচ্ছি।
ওরা পর পর দুটো মাঠ পেরিয়ে একটা সরু গোছের ভাঙ্গাচোরা রাস্তা ধরে গিয়ে পড়ে এক রুক্ষ ধূসর জঙ্গলের পথে।
ব্রিজেটের তখন দুটো কবিতার লাইন মনে ওঠে,
দস্তানা চাপিয়ে হাতে কেন যাও বনপথে,
অয়ি, ধূসর-বরণ কৃশাঙ্গী ভালোবাসা যার নেই বরাতে!
মিস্ ওয়েনফ্লিটের কথায় ওর চিন্তায় ছেদ পড়ে।
কথাগুলোর মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা না থাকলেও কী যেন একটা অজানা স্পর্শে ব্রিজেট চোখ মেলে তাকায়। মিস ওয়েনফ্লিট ব্রিজেটের দিকে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন করেন-তোমার খুব ঘুম পাচ্ছে, না?
ব্রিজেটের এবার আর ভুল হয় না। ভদ্রমহিলার প্রশ্নের প্রচ্ছন্ন সুর সেই প্রায় অদৃশ অনুভূতিকেই এবার সাকার করে তোলে।
তাহলে ও ঠিকই ভেবেছিলো। ও ভেবেছিলেন যে একান্ত গোপনে, কারুকে না বলে ও নিজেই সেই ক্ষীণ সন্দেহের সত্য-মিথ্যে যাচাই করে নেবে। ও ধরেই নিয়েছিলো যে, ওর সন্দেহের কথা কেউ টের পায়নি; তাছাড়া, এত তাড়াতাড়ি যে আক্রমণ আসবে, তাও ছিলো ওর চিন্তার বাইরে। খোকা!–একেবারে ও নিরেট মূর্খ!
চট করে মনে পড়লো–চা!–চায়ের মধ্যে কিছু ছিলো। আমি চা খাইনি সেটা জানে না। এই সুযোগ নিতে হবে! ঘুমের ভান করতে হবে। চায়ের মধ্যে কী থাকতে পারে?-বিষ?-নাকি শুধুই ঘুমের ওষুধ? আশা করছে যে আমার ঘুমিয়ে পড়া উচিত–কথা থেকে সেটা পরিষ্কার।
ও আস্তে আস্তে আবার চোখের পাতা বন্ধ করে যথাসাধ্য ঘুমের ভান করে বলে–পাচ্ছে দারুণ। কী আশ্চর্য! কখনো আমার এত ঘুম পায় না।
মিস ওয়েনফ্লিটের মাথাটা অতি ধীরে দোলে।
ও মিস ওয়েনফ্লিটের ওপর নজর রাখে চোখের সূক্ষ্ম ফাঁক দিয়ে, আর চিন্তা করে–যাই আসুক না কেন সহজে আমার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না। কিন্তু ওকে দিয়ে সর্বপ্রথম কথা বলাতে হবে–ওর স্বীকারোক্তি যে দরকার।
গলার স্বর এবার কিছুটা চড়িয়ে আতঙ্কিত সুরে বলে-বুঝতে পারছি না আমার কি হলো!…কেমন যেন লাগছে…অত্যন্ত খারাপ লাগছে।
চতুর্দিকে চকিতে একবার দেখে নিলেন মিস ওয়েনফ্লিট। জায়গাটা একেবারে জনমানব শূন্য। গ্রামের থেকে বেশ খানিকটা দূর-চিৎকার করলে কারুর কানে পৌঁছবে না।
ধারে কাছে কোথাও কুঁড়েঘর পর্যন্ত নেই। কাঁপা কাঁপা হাতে মহিলা পুরানো কাপড়ের মোড়কটা আঁটছেন–মোড়কটা খুলে যেতে একটা বড় উলের পোশাক টেনে বের করে আবার কী যেন একটা খুঁজছেন–তখনও হাতে দস্তানা।
দস্তানা চাপিয়ে হাতে, কেন যাও বন পথে–কেন? দস্তানা কেন?…ঠিক, ঠিক। সমস্ত ব্যাপারটাই নিখুঁতভাবে পূর্বপরিকল্পিত।
কাগজের মোড়কটা খুলতেই তার মধ্য থেকে সেই ছুরি বেরিয়ে এলো। অতি সাবধানে হাতে ধরা, যাতে লর্ড হুইটফিল্ডের আজ সকালের হাতের ছাপ নষ্ট না হয়ে যায়। এইজন্যই হাতে দস্তানা?
ব্রিজেটের গা গুলিয়ে উঠলো। গলাটা ঈষৎ খরখরে করে নিস্তেজ স্বরে ও জিজ্ঞেস করে–ওটা কী? ছুরি?
মিস ওয়েনফ্লিট সঙ্গে সঙ্গে হেসে ওঠেন। সে হাসি বড় সাংঘাতিক। উনি বলেন–এটা তোমার জন্য ব্রিজেট, একান্তই তোমার জন্য। দীর্ঘকাল ধরে আমি তোমায় ঘৃণা করে এসেছি, তুমি হয়তো সে কথা জানোও না।
ব্রিজেট বললো–কেন? আমার গর্ডন-এর সঙ্গে বিয়ে হবার কথা ছিলো। সেইজন্য?
মিস ওয়েনফ্লিট বললেন–তুমি চালাক–অত্যন্ত চালাক মেয়ে; এবং তুমিই হবে ওর বিরুদ্ধে এক জলজ্যান্ত সাক্ষ্য। তোমার দেহ থেকে মাথাটা কাটা অবস্থায় এখানে পাওয়া যাবে এবং তার সঙ্গে পাওয়া যাবে ওরই ছুরি, আর সেই ছুরির হাতলে পাওয়া যাবে ওরই হাতের ছাপ! আজ সকালে এই ছুরিটা দেখতে চাওয়া কি দারুণ বুদ্ধির খেলা বলো তো? এবং তোমরা যখন ওপরে ব্যস্ত তারই ফাঁকে ছুরিটাকে রুমালে জড়িয়ে ব্যাগের মধ্যে রেখে দেওয়া কত সহজ কাজ! সমস্ত ব্যাপারটা যে এত সহজে হবে ভাবতেই পারিনি।
ব্রিজেট বললো–ওটা পেরেছেন কারণ আপনি একেবারে শয়তানের মতো ধূর্ত।
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–ঠিকই বলেছো, ছোটবেলা থেকেই আমার প্রচণ্ড বুদ্ধি। গর্ডন এলো–একজন সাদা-মাটা মুচির ছেলে; কিন্তু ওর খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিলো। তখন থেকেই আমি জানতাম ও একদিন মাথা তুলে দাঁড়াবে–আর ওই কিনা আমাকে প্রত্যাখ্যান করলো! আমাকে প্রত্যাখ্যান। সবকিছু ঘটেছিলো সেই বিশ্রী বিরক্তিকর পাখিটাকে কেন্দ্র করে।
গর্ডন র্যাগ প্রত্যাখ্যান করলো আমাকে কর্নেল ওয়েনফ্লিটের মেয়েকে। সেদিনই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে আমি এর প্রতিশোধ নেব। দিনের পর দিন রাতের পর রাত ভেবেছি; আর দিন দিন আমাদের অবস্থাও পড়ে যেতে লাগলো–আমরা গরীব হয়ে গেলাম, বাড়িটাও বিক্রি হয়ে গেলো–ওই কিনলো! আমাকে সাহায্য করার জন্য ও আমারই বাড়িতে আমাকে একটা চাকরি দিলো। আর তখন ওর ওপর আমার আরও বেশি ঘৃণা হলো। কিন্তু বুঝতে দিইনি আমার অন্তরের ইচ্ছে। ছোটোবেলায় আমি এই একটা প্রচণ্ড দামী শিক্ষা পেয়েছিলাম যে, মনের কথা মনেই চেপে রাখতে হয়।