এছাড়া, আরো কী আছে বলো?
ওই কথাগুলো ও যেভাবে বলেছিলো, সেই ভঙ্গীটাই হলো আসল; কথার সুরে ছিলো নিস্তরঙ্গ, শান্ত আত্মতুষ্টির আমেজ যেন বহুদিনের এক বদ্ধমূল বিশ্বাস থেকে প্রত্যেকটি কথা বলেছিলো। আর তখন ওর চোখমুখের প্রতিটি রেখায় যে হাসির সূক্ষ্ম প্রকাশ আমি দেখেছি তা যদি তুমি দেখতে, সমস্ত শরীরে একেবারে শিহরণ জাগানো অভিব্যক্তি। তারপর যেসব লোক ওর বিরুদ্ধাচরণের জন্য মারা গেছে, তাদের নামের তালিকা আর বিবরণ দিলো। মিসেস হর্টন, অ্যামি, টমি পিয়ার্স, হ্যারি কার্টার, আম্বলবি আর সেই ড্রাইভার রিভার্স।
আতঙ্কিত হয়ে ব্রিজেট বলে ওঠে–যারা সত্যি সত্যি মারা গেছে ও তাদেরই নাম করলো?
হা, হুবহু সেই নামগুলো। এবারে বিশ্বাস করলে তো?
ওঃ ভগবান! না করে পথ নেই? কিন্তু এর পেছনে ওর কী উদ্দেশ্য ছিলো।
একেবারে তুচ্ছ কারণ এবং সেটাই হচ্ছে আরো ভয়ঙ্কর। মিসেস হর্টন ওকে একবার কড়া কড়া কথা শুনিয়েছিলো; টমি পিয়ার্স একদিন ওকে অনুসরণ করে বাগানের মালীদের হাসিয়েছিলো; হ্যারি কার্টার কবে একবার ওকে খুব গালাগাল করেছিলো; অ্যামি গিবস্ অত্যন্ত অভব্য আর অভদ্র আচরণ করেছিলো ওর সঙ্গে; আম্বলবি জনসমক্ষে ওর বিরোধিতা করার দুঃসাহস দেখিয়েছিলো আর রিভার্স মিস ওয়েনফ্লিট এবং আমার সামনে ওকে শাসিয়েছিলা।
আতঙ্কে ব্রিজেট বলে ওঠে–কী ভয়ানক নির্মমতা–কী নিদারুণ…
এছাড়া বাইরের কিছু প্রমাণ আছে; যে গাড়ি মিস পিঙ্কারটনকে লন্ডনে চাপা দিয়েছিলো, সেটা ছিলো রোলস্ এবং সেই গাড়ির নম্বর আর হুইটফিল্ডের গাড়ির নম্বর এক।
এতেই তো সব প্রমাণ হয়ে যায়।আস্তে আস্তে ব্রিজেট বলে।
একথা সহজেই বোঝা যায়। লর্ড-এর মতো একজন বিত্তশালী ক্ষমতাবান লোকের সম্পর্কে কিছু বললে সহজে কেউ বিশ্বাস করবে না; বরঞ্চ ওর কথাই আগে বিশ্বাস করে নেবে।
তাহলেই দেখো, মিস পিঙ্কারটনেরও এই একই অসুবিধে ছিলো।
ব্রিজেট বলে–মিস পিঙ্কারটন দুএকবার আমাকেও কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন, আমি তখন বুঝে উঠতে পারিনি–মনে হয়েছিলো যেন কোনো বিপদ-আপদ থেকে আমাকে সাবধান করতে চেয়েছিলেন। এখন তার অর্থ বুঝতে পারছি।
এভাবে একত্র করলে দেখবে সবই ছকে মিলে যাচ্ছে। মিসেস হর্টনকে আঙুর পাঠালো হুইটফিল্ড, ওদিকে ভদ্রমহিলা ধরেই নিয়েছিলেন যে, নার্সরাই ওঁকে বিষ খাওয়াচ্ছে। ওয়েলারম্যান ক্রেইৎস গবেষণাগার দেখতে যাওয়ার মধ্যেও ওই একই উদ্দেশ্য। যেভাবেই হোক, ও সেখান থেকে কোনোরকমে একটা জীবাণু যোগাড় করে এনে আম্বলবির হাতের ক্ষতস্থানে সংক্রামিত করেছে।
আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না যে কী করে সেটা সম্ভব হলো।
আমিও জানি না। কিন্তু একথা ভুললে চলবে না যে একটা যোগসূত্র ছিলো।
তা চলবে না, তোমার কথায় বলা যায় যে, মিলে যাচ্ছে। তাছাড়া, অন্যের কাছে যা একেবারে অসম্ভব, ওর কাছে তা নয়, কারণ ওকে কেউ সন্দেহই করবে না।
তবে আমার ধারণা মিস ওয়েনফ্লিট সন্দেহ করেছিলেন। খুব আলগা করে কথায় কথায় সেই গবেষণাগারের প্রসঙ্গে দুএকটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন যে, আমি সেই ইঙ্গিত ধরে এগোতে পারবো।
উনি তাহলে প্রথম থেকেই জানতেন?
অন্ততঃ একটা দৃঢ় সন্দেহ ছিলো। তবে, এককালে ভালোবাসতেন বলে একটা অসুবিধেও ছিলো।
ঘাড় নাড়ে ব্রিজেট।-হা, এর থেকেই অনেক ঘটনার হিসেব পাওয়া যায়। গর্ডন একবার আমাকে বলেছিলো যে, ওদের দুজনের বিয়ে হবার কথা একেবারে ঠিক হয়ে গিয়েছিলো।
কি জানো, উনি মনে মনে চেয়েছিলেন যে, গর্ডন যেন সেই লোক না হয়; কিন্তু দিনে দিনে উনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ও-ই আসলে সেই লোক। আমাকে কিছু কিছু ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন কারণ ওর বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু করতে গিয়ে মিস ওয়েনফ্লিটের কিছুতেই মন সরছিলো না। একদিক থেকে মেয়েরা সত্যিই অদ্ভুত! আমার তো বিশ্বাস যে, ভদ্রমহিলা এখনও লোকটাকে অন্তর থেকে ভালোবাসেন…
ব্রিজেট দুএক মিনিট গভীর চিন্তায় ডুবে থেকে হঠাৎ প্রশ্ন করে–সেদিন ট্রেনে মিস পিঙ্কারটন তোমাকে ঠিক কী বলেছিলেন এবং কিভাবে আরম্ভ করেছিলেন বলো তো?
লিউক বলে-বলেছিলেন যে উনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে যাচ্ছেন। এছাড়া গ্রামের পুলিশটির সম্পর্কে বলেছিলেন যে, এমনিতে নাকি লোকটি ভালো, তবে খুনের তদন্ত করার যোগ্যতা নেই।
এই বলেই কী কথা আরম্ভ করেছিলেন?
হা।
তারপর বলো।
তারপর উনি বলেছিলেন–বুঝতে পারছি আপনি আশ্চর্য হচ্ছেন, প্রথমটায় আমিও হয়েছিলাম–বিশ্বাসই করতে পারিনি। এমনও মনে হয়েছিলো যে, আমি সব কল্পনার চোখে দেখছি।
তারপর?
আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করলাম যে, উনি ঠিক জানেন কিনা যে কল্পনার দৃষ্টিতে দেখেননি। এর জবাবে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে উনি বললেন–কক্ষনো না। প্রথমটায় হয়তো মনে হতে পারতো; কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থবার যখন একই ঘটনা ঘটলো তখন আর কোনো সন্দেহ রইলো না। মন্তব্য করলো ব্রিজেট–অপূর্ব! বলল, বলে যাও।
আমি অবশ্য একটু ঠাট্টা করেই বলছিলাম যে উনি নিশ্চয়ই ঠিকই দেখেছেন। আসলে আমার মনোভাব তখন ছিলো একেবারে খাঁটি একজন অবিশ্বাসী টমাসের মতো।
জানি এমনই হয়। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। আমারও হয়তো একই মনোভাব হতো, নিজেকে ওই বৃদ্ধার থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমতী ভাবতাম। যাই হোক, তারপর কী নিয়ে আলোচনা করলে?