এক পা এগিয়ে গিয়ে আবার একই প্রশ্ন করে লিউক–বলুন আপনি কী বলতে চান?
লর্ড বললেন–হনরিয়া ওয়েনফ্লিটকে জিজ্ঞেস করুন, ও বুঝতে পারবে। তাছাড়া ওর সব জানাও আছে, আমার সঙ্গে ও এ নিয়ে একবার কথা বলেছিলো।
উনি কী বুঝতে পারবেন?
বুঝতে পারবে যে পাপের শাস্তি অনিবার্য! ন্যায়ের দণ্ড অমোঘ! ব্রিজেটকে আমি ভালোবাসতাম; আজ আমি সেজন্য দুঃখিত। অপর পক্ষে, আমি আপনাদের দুজনের জন্যও দুঃখবোধ করছি।
আপনি আমাদের ভয় দেখাচ্ছেন?–প্রশ্ন করে লিউক।
লর্ড হুইটফিল্ড কথাটা শুনে যথার্থ আঘাত পেয়েছেন বলে মনে হলো।
না না, ভাই, ভয় দেখাচ্ছি না। ব্রিজেটকে আমি যখন স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চেয়েছিলাম, ও পূর্ণ দায়িত্বের সঙ্গে তা গ্রহণ করেছিলো। বিধান অমান্য করলে তার শাস্তি অবধারিত…
লিউক বলে–অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন যে, ব্রিজেটের একটা কিছু ঘটবে? আপনি যদি তেমন কিছু পরিকল্পনা করে থাকেন, তাহলে এখানেই আপনার খেল খতম। নিজের ভালো যদি চান, তাহলে সাবধান। আপনার জারিজুরি সবই আমি ধরে ফেলেছি।
হুইটফিল্ড বলেন–আমাকে নিজে কিছুই করতে হবে না–আমি এক সুবিশাল শক্তির যন্ত্র মাত্র। সেই শক্তি যে শাস্তির বিধান দেবেন, তাই-ই ঘটবে।
আপনি সেই বুজরুকীকে বিশ্বাস করেন?
করি, কারণ তাই-ই সত্যি। সে আমার বিরুদ্ধাচরণ করবে তাকেই শাস্তি পেতে হবে–আপনি বা ব্রিজেট তার ব্যতিক্রম হতে পারেন না।
এখানেই তো ভুল করলেন। ভাগ্য চিরকাল কারো সুপ্রসন্ন থাকে না। এক সময় ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায়। আপনার সেই সময় উপস্থিত হয়েছে।
লর্ড বললেন–ওহে যুবক, আপনি জানেন না, কার সম্পর্কে আপনি কথা বলছেন। এ বিশ্বচরাচরে কিছুই আমাকে ছুঁতে পারে না।
পারে না বুঝি? এবার সব টের পাবেন। এখন থেকে একটু হিসেব করে পা ফেলবেন হুইটফিল্ড।
এবার লর্ড হুইটফিল্ডের আর আগেকার সেই শান্ত, স্থির ভঙ্গীটা আর নেই।
এতক্ষণ আমি অসীম ধৈর্য নিয়ে সব শুনে গেছি; কিন্তু আমারও সহ্যের একটা সীমা আছে। বেরিয়ে যান এখান থেকে।
তা যাচ্ছি এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাচ্ছি। কিন্তু পরে যেন বলবেন না যে, আমি আপনাকে সতর্ক করে দিইনি।
লিউক বেরিয়ে একছুটে ওপরে উঠে গেল। সেখানে একজন ঝি ব্রিজেটের জামাকাপড় গুছিয়ে দিচ্ছিলো আর ব্রিজেট তার তদারকী করছিলো।
এত জলদি হয়ে গেল?
এই, আর দশ মিনিট।
মিনিট দশেক বাদে ফিরে এসে দেখে ব্রিজেট প্রস্তুত।
আমরা কি এখন যাবো।
চলো, আমি তৈরি।
সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময়ে দেখলো পাঁচক ওপরে উঠছে।
মেমসাহেব, মিস ওয়েনফ্লিট। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।
মিস ওয়েনফ্লিট? কোথায়?
বসবার ঘরে-সাহেবের সঙ্গে কথা বলছেন।
ওরা বসবার ঘরে সোজা চলে যায়; লিউক একেবারে গা ঘেঁষে ব্রিজেটের পেছনে থাকে।
জানালার কাছে দাঁড়িয়ে লর্ড হুইটফিল্ড মিস ওয়েনফ্লিটের সঙ্গে কথা বলছিলো, হাতে একখানা ছুরি-ফলাটা লম্বা আর কিঞ্চিৎ বাঁকানো।
নিখুঁত হাতের কাজ। আমার কাগজের একজন সাংবাদিক মরক্কো থেকে এটা আমাকে এনে দিয়েছিলো। মরক্কোয় রিফ জেলায় তৈরি। কিন্তু আরবী জিনিষ হলেও কী দারুণ ধার!–লর্ড হুইটফিল্ড ছুরিটার ধার পরীক্ষা করছিলেন–মুখে তৃপ্তির দ্যুতি।
মিস ওয়েনফ্লিট বললো-দোহাই গর্ডন, ওটা সরিয়ে রাখো।
তারপর লর্ড বললেন–এই ছুরিটাকে স্পর্শ করেও আমি আনন্দ পাই।
মিস ওয়েনফ্লিটকে অত্যন্ত ফ্যাকাসে আর উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিলো।
বাঃ, এই যে ব্রিজেট, এসে গেছো? লক্ষ্মী মেয়ে।
লর্ড বললেন–হ্যাঁ, এই তো ব্রিজেট এসে গেছে; মনের সাধ মিটিয়ে ওর সঙ্গে গালগল্প করে নাও হনরিয়া, ও আর আমাদের মধ্যে বেশিক্ষণ নেই।
মিস ওয়েনফ্লিট ঝঙ্কার দিয়ে ওঠেন–তার মানে কী?
মানে? মানে হচ্ছে যে, ও লন্ডনে চলে যাচ্ছে, কী? ঠিক বলেছি?–এই হলো আসল মানে।
লর্ড আবার বলেন–তোমাকে একটা সুসংবাদ দিচ্ছি হনরিয়া, ব্রিজেট শেষ পর্যন্ত আর আমাকে বিয়ে করছে না; ফিৎস উইলিয়ামকেই বেছে নিয়েছে। জীবনের গতি বড়ই বিচিত্র! আচ্ছা তাহলে তোমরা গল্প-গুজব করো, আমি চলি।
লর্ড হুইটফিল্ড বাইরে চলে যান।
কী সর্বনাশ! কী দারুণ সর্বনাশ!–মিস ওয়েনফ্লিটের কথার মধ্যে হতাশা, আতঙ্ক এতই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ব্রিজেট বেশ বিস্মিত হয়ে যায়। ও বলে–কী যে হচ্ছে! আমি খুব লজ্জিত এবং আন্তরিক দুঃখিত।
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–ও দারুণ রেগে গেছে! এখন কী হবে? আমরা এখন কী করবো?
ব্রিজেট বলে–কী করবো মানে? আপনি কী বলতে চাইছেন?
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–তোমাদের আজই ওকে বলা উচিত হয়নি।
ব্রিজেট বললো–কী বলছেন? না বলে আমরা কী করতাম?
এক্ষুনি না বললেও চলতো। যতক্ষণ না তোমরা এখান থেকে নিরাপদে চলে যেতে পারছো, ততক্ষণ অপেক্ষা করা উচিত ছিলো।
সেটা তর্ক-সাপেক্ষ। আমার মতে এই জাতীয় বিরক্তিকর ব্যাপার যত তাড়াতাড়ি শেষ করা যায় ততই মঙ্গল।
ওঃ বুঝতে পারছে না, এই ব্যাপার যদি কেবল তাই-ই হতো তাহলে।
পুরো কথা শেষ না করে স-প্রশ্ন চোখে লিউকের দিকে তাকান।
লিউকও নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়িয়ে বলে যে,–এমনও বলা উচিত হয়নি।
বিড় বিড় করে মিস ওয়েনফ্লিট ও আচ্ছা বলে থেমে যান।
ব্রিজেট বলে–আপনি কি কোনো বিশেষ কারণে আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন মিস ওয়েনফ্লিট?
ও হ্যাঁ, আমি বলতে এসেছিলাম যে, এখানে তো আর থাকাটা ভালো দেখায় না। কিন্তু ঠিকঠাক করে কোনো একটা ভালো জায়গায় যেতে হলে দুএকদিনের সময়েরও প্রয়োজন–এই দুএকটা দিন তোমরা আমার ওখানেই থেকে যাও।