বিমূঢ় দৃষ্টিতে লিউক তাকায়।
লর্ড হুইটফিল্ড বলেন–প্রথমটায় আমি বিশ্বাস করতে পারতাম না, কিন্তু প্রতিবারই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। যারাই আমার শত্রু এবং বিরোধী, তারাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়?
লর্ড হুইটফিল্ড গম্ভীর ভাবে মাথা ঝাঁকান।
বার বার ঘটলো। একটা ঘটনা একেবারে এলিসার মতো–একটা বাচ্চা ছেলে ও–আমার কাছে সেই সময়ে চাকরি করতো। একদিন ওকে এই বাগানেই ধরে ফেললাম। জানেন, ও তখন কী করছিলো? একগাদা লোক যোগাড় করে আমার অনুকরণ করে আমাকে ব্যঙ্গ করেছিলো। আমার বাড়িতে বসে আমাকেই অপমান? আর কাউকে নয়, আ-মা-কে! জানেন ওর কী হলো? দশ দিনও কাটলো না–একটা উঁচু জানলা থেকে পড়লো আর মরলো।
তারপর এই গুণ্ডাটা–কার্টার! লোকটা যেমন মাতাল ছিলো, তেমনি ছিলো ওর অশ্রাব্য মুখ। ও এখানে এসে আমাকে গালাগাল করে গেল! ওরই বা কী হলো? এক সপ্তাহের মধ্যে পাঁকের মধ্যে ডুবে মারা গেল। আমার এখানে একটি ঝি ছিলো–সেও একদিন চিৎকার করে আমাকে যা-নয়-তাই বলে গালমন্দ করলো; কয়েক দিনের মধ্যে ওরও শাস্তি হলো-ভুল করে ওষুধের বদলে বিষ খেলো। এইরকম অজস্র উদাহরণ আছে। আম্বলবি! জল সরবরাহ নিয়ে আমার পরিকল্পনার বিরোধিতা করে বসলো আর রক্তে বিষক্রিয়ার ফলে শেষ হলো। এই রকমটাই হয়ে আসছে দীর্ঘদিন যাবৎ। মিসেস হর্টন–আমার সঙ্গে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করেছিলেন একবার। কিছু দিনের মধ্যে তিনিও মারা গেলেন।
অপলক দৃষ্টি লিউকের চোখে। ওর মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে সাপের মতো কুটিল সন্দেহ। বিদ্যুতের মতো ওর মাথায় খেলে যায় পুরানো অনেক কথা। একদিন মেজর হর্টন বলেছিলেন–লর্ড হুইটফিল্ড অত্যন্ত সহৃদয় ব্যক্তি। একদিন নিজের বাগানের আঙুর আর পিচফল পাঠিয়েছিলেন।–এই লর্ড হুইটফিল্ডই দয়াপরবশ হয়ে টমিকে লাইব্রেরির জানলা
পরিষ্কার করার কাজে লাগিয়ে ছিলেন। আবার এই লর্ডই ওয়েলারম্যান ক্রেইৎস গবেষণাগারে গিয়ে নানারকম বিষাক্ত রসায়ন আর জীবাণু সম্পর্কে সর্বসমক্ষে জাহির করেছিলেন। আম্বলবির মৃত্যুর কয়েকদিন আগে ওখানে গিয়েছিলেন। এই সব ঘটনা বিশ্লেষণ করলে একই দিকেরই নির্দেশ পাওয়া যায়–আর ও নিজে এমন মূর্খ যে, এই সম্ভাবনার কথা ওর মনেই আসেনি–এমনকি সামান্য সন্দেহ পর্যন্ত করেনি…।
তখনো মৃদু মৃদু হাসছিলেন লর্ড হুইটফিল্ড, আত্মতুষ্টিতে পরিপূর্ণ সেই হাসি। একটু এগিয়ে লিউককে বললেন–ওরা সবাই একে একে মরলো।
***
৪. লন্ডনে শলাপরামর্শ
পুলিশ-মহলে বিলিবোন্স্ নামে খ্যাত স্যার উইলিয়াম ওসিংটন বন্ধুর দিকে কতকটা হতভম্বের মতো তাকিয়ে বলেন–মেয়াং-এ অপরাধীদের শায়েস্তা করেও তোমার সাধ মেটেনি। দেশে ফিরেও আমাদের কাজে বাগড়া দিয়ে বেড়াচ্ছো?
মেয়াং-এ অপরাধীরা এমন পাইকারী হারে খুন করে না। এক্ষেত্রে আমার মাথাব্যথার কারণ এই যে একটা লোক প্রায় আধডজন খুন করেও দিব্যি খোলা হাওয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে–এমনকি কেউ তাকে সন্দেহ পর্যন্ত করছে না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন স্যার উইলিয়াম–কখনো কখনো এমনটা ঘটে। এক্ষেত্রে খুন করার বিশেষত্ব কী? স্ত্রী খুন করা?
না না, এ লোকটা তা নয়; তা নিজেকে এখনও ভগবান বলে মনে করেনি, তবে অচিরেই করবে।
পাগল নাকি?
নিঃসন্দেহে।
ওহো, কিন্তু আইনের চোখে পাগল নয় এবং সেটাই আসল কথা।
তবে আমার ধারণা, ও জানে যে ওর কাজের কী পরিণাম। বললো লিউক।
সে কথাই তো বলছি।
আমি তাই তোমার কাছ থেকে দুএকটা ঘটনা জানতে চাই। ডারবি খেলার দিন বিকেল পাঁচটা থেকে ছটার মধ্যে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিলো। মিস পিঙ্কারটন নামে এক বৃদ্ধা মহিলাকে হোয়াইট হলের সামনে একটা গাড়ি চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। আমি চাই যে, এই ব্যাপারটার একটু বিশদ তদন্ত হোক।
স্যার উইলিয়াম বললেন–ঐটুকু সহজেই তোমার জন্য করতে পারি–বিশ মিনিটের বেশি লাগবে না।
কথামতই কাজ হলো।
আজ্ঞে হ্যাঁ, এই ঘটনার একেবারেই পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা আমার মনে আছে। তাছাড়া এই ফাইলে লেখাও আছে।–লিউককে ফাইলটা দিয়ে বললো-তদন্ত-সাপেক্ষ একটা বিচার হয়েছিলো–মিঃ স্যাচের ভেরেল বিচারক। গাড়ির চালক নিরুদ্দেশ।
ওকে পরে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো?
আজ্ঞে না।
গাড়িটা কী গাড়ি ছিলো?
যতদূর মনে হয় ওটা রোলস্ ছিলো। বড় গাড়ি এবং গাড়ির চালক ছিলো পেশাদার চালক।
নম্বর যোগাড় করতে পেরেছিলেন?
ওখানেই ভুল হয়ে গেছে। একটা নম্বর পাওয়া গিয়েছিলো-এফ. জেড. এক্স ৪৪৯৮। এক ভদ্রমহিলার এই নম্বরটা মনে ছিলো, কিন্তু পরে দেখা গেল সেই নম্বরটা ভুল।
কী করে জানলেন যে সেই নম্বরটা ভুল?–লিউকের কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ।
অফিসারটি হেসে ফেলেন–এফ. জেড, এক্স. ৪৪৯৮ হচ্ছে লর্ড হুইটফিল্ডের গাড়ি। যখন এই ঘটনাটা ঘটে সেই সময়ে এই গাড়িটা বুসিংটন হাউসের ঠিক বাইরে দাঁড়িয়েছিলো আর গাড়ির ড্রাইভার তখন চা খাচ্ছিলো। এই ঘটনার সঙ্গে কোনোরকমেই ওকে জড়ানো সম্ভব নয়, তা ছাড়া সাড়ে ছটা নাগাদ লর্ড হুইটফিল্ড বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত গাড়িটাও তখন থেকে নড়েনি।
ও, আচ্ছা।-মন্তব্য করে লিউক।
হাঁফ ছেড়ে লোকটি বলেন–এই রকমই হয়। ঘটনাস্থলে পুলিশ এসে সব বিবরণটুকু নেবার আগেই অর্ধেক এর ওপর সাক্ষী হাওয়া হয়ে যায়। স্যার উইলিয়ামও একথা স্বীকার করেন।