ব্রিজেট বললো-আজ সারাদিন তুমি কী করলে?
সেই গতানুগতিক ব্যাপার-খবর সংগ্রহ।
কিছু পেলে?
রাজনৈতিক ভাষায় হা এবং না–দুটোই বলা চলে। ভালো কথা বাড়িতে কোনো যন্ত্রপাতি পাওয়া যাবে?
তা হয়তো যাবে। কিন্তু কী ধরনের যন্ত্রপাতি?
এই ছোটোখাটো কিছু? আচ্ছা, আমি নিজেই দেখে নিচ্ছি।
একটা পেয়েছি। ওতেই কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে।
তুমি জোর করে কোথাও দরজা খুলে ভেতরে ঢোকবার মতলব করছো না কি?
হতে পারে।
মনে হচ্ছে, যেন তুমি ব্যাপারটা গোপন করতে চাইছো?
ব্যাপারটা কি জানো, আমার নিজের অবস্থা খুব একটা স্বচ্ছ ও স্বাভাবিক নয়। শনিবারের সেই ঘটনার পর নিজে থেকেই হয়তো আমার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু মুশকিল হয়েছে যে, এক মদমত্ত খুনীকে খুঁজে বের করবার উজ্জ্বল সম্ভাবনার ফলে এখানে বাধ্য হয়ে থেকে যেতে হচ্ছে। তবে, বেল-মোটলি অতিথিশালায় গিয়ে ওঠবার মতো কোনো যুৎসই কারণ যদি বলতে পারো, তাহলে না হয় ওখানেই যাই।
ব্রিজেট বলে–নাঃ, তা সম্ভব নয়। বিশেষ করে তুমি যখন আমার দূরসম্পর্কের ভাই। তাছাড়া ওখানে মাত্র তিনখানা ঘর। সব ঘর এখন এলসওয়ার্দির সাঙ্গপাঙ্গতে ভর্তি।
অতএব, এখানেই থেকে যেতে হচ্ছে তাতে তোমার যত কষ্টই হোক না কেন।
কষ্ট আর কি, এমন দুচারজন নিরেট লোকজনকে নিয়ে আমি অনায়াসে চালিয়ে নিতে পারি।
লিউক বলে–এ কিন্তু তোমার একান্তই রূঢ় অভিব্যক্তি। বস্তুতঃপক্ষে, তোমার চরিত্রে মমতাবোধের কোনো রকম বালাই নেই।
তারপর লিউক নিজের ঘরে চলে যায়। ওর মাথায় অনেক চিন্তা। ঘরে গেলেও বিছানায় যায় না।
রাত বারোটার সময় টেনিস খেলার জুতো পড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে লাইব্রেরি ঘরের জানলা দিয়ে গলে বাইরে বের হয়।
লিউক ইচ্ছা করেই ঘুরপথ ধরলো এলসওয়ার্দির বাড়ি যাবার জন্য। আজ গ্রীষ্মের রাত। এমন রাতে এলসওয়ার্দি ও তার বন্ধুরা কিছুতেই ঘরে থাকবে না। সেই সুযোগে এলসওয়ার্দির বাড়িঘর মনের সাধ মিটিয়ে খুঁজে নিতে পারবে।
দুএকটা দেওয়াল টপকে ও বাড়ির পেছন দিকটায় এসে উপস্থিত হলো। যন্ত্রপাতির মধ্যে থেকে একটা যন্ত্র বেছে নিয়ে রান্নাঘরের একটা জানলার পাল্লা নিয়ে কিছুক্ষণ খুটখাট করতেই জানলাটার ছিটকিনিটা খুলে গেল। সার্সিটা ওপরে ঠেলে সহজে ভেতরে গিয়ে উপস্থিত হলো।
অতি সাবধানে মিনিট পনেরো ধরে খোঁজাখুঁজির পর ও নিশ্চিন্ত হয় যে, বাড়ি একেবারে ফাঁকা, বাড়ির মালিক অন্যত্র আপন কাজে ব্যাপৃত।
লিউক ঘরের প্রতিটি কোণ এবং অংশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে। এছাড়া দুএকখানা পাকা হাতে আঁকা ছবি দেখে লিউক অবাক হয়ে যায়। আলমারির একেবারে দেওয়াল ঘেঁষে রাখা কয়েকখানা বই দেখে ও বেশ উৎসাহ বোধ করলো।
এগুলো ছাড়া আরও তিনটে জিনিস ও পেলো। প্রথমটা, একটা নোটবই। তাতে লেখাটমি পিয়ার্সের সঙ্গে একটা মীমাংসা করো–লেখার তারিখ ছেলেটির মৃত্যুর আগের দিন। দ্বিতীয়ত, পেনসিল দিয়ে আঁকা অ্যামি গিবসের একখানা ছবি। ছবিটার মুখে গভীর লাল রং দিয়ে একটা ক্রশ চিহ্ন। তৃতীয়টি–এক বোতল কাশির ওষুধ। বিচ্ছিরিভাবে দেখলেই এর কোনোটাই সঠিক কোনো প্রমাণ দেয় না, কিন্তু এই নিদর্শনগুলো একত্র করলে একটা অর্থ বহন করে।
যখন লিউক জিনিষপত্র গোছগাছ করছিলো, তখন বাইরের দরজায় চাবি খোলার শব্দ পেয়েও কিছুক্ষণ টর্চের আলো নিবিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইলো। ওর আশঙ্কা এলসওয়ার্দিই এসেছে। যদি তাই হয়, তবে তার সোজা ওপরে উঠে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
এলসওয়ার্দি পাশের একটা দরজা খুলে ঢোকে। এলসওয়ার্দি একটি সুইচ টিপে হল ঘরের আলো জ্বালায়।
হলঘর পেরিয়ে যাবার সময় লিউক ওর মুখখানা দেখতে পেয়ে আতঙ্কে একেবারে শিউরে ওঠে।
তাকে চেনবার উপায় নেই মুখ দেখে। ঠোঁটের দুই কোণে বজ বজ করে একরাশ ফেনা, চোখের দৃষ্টিতে উদ্ভ্রান্তি, চলার সময়ে মনে হচ্ছিলো যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নাচছে। এলসওয়ার্দির দুটো হাতেই ঈষৎ বাদামী লাল রং–যেমন রক্ত শুকিয়ে গেলে হয়ে থাকে।
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যাবার একটু পরেই নিভে যায় হলের আলো।
লিউক হলঘরের ভেতর দিয়ে রান্নাঘরের সেই জানলা দিয়ে বেরিয়ে আসে। বাইরে এসে একবার বাড়িটার দিকে তাকায়–সমস্ত বাড়ির ভেতরটা একেবারে নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে থম্ থম করছে।
লিউক মনে মনে বলে,–লোকটা একেবারে বদ্ধ উন্মাদ। ওর মনে কী আছে কি জানি! ওর হাতে ওটা নিশ্চয়ই রক্তের দাগ!
বেশ কিছুক্ষণ বাদে ও অ্যাশম্যানরে ফিরে আসে। বাড়ির প্রান্তসীমায় ঢোকবার জন্য ছোটো একটা গলিপথে পা দিতেই শুকনো পাতার খস্ খস্ শব্দে চমকে একবারে ঘুরে দাঁড়ায়।
কে ওখানে?
আগাগোড়া কালো কাপড়ে ঢাকা একটা লম্বা মূর্তি। তা দেখে লিউকের মনে হল যেন হৃৎপিণ্ডটা থেমে গেছে। কিন্তু কাছে আসতেই ঢাকনার আড়ালের মুখখানা চিনতে পেরেই বলে–ব্রিজেট? ওঃ, আমাকে একেবারে চমকে দিয়েছিলে।
ব্রিজেট প্রশ্ন করে–তুমি কোথায় গিয়েছিলে? তোমাকে আমি বেরিয়ে যেতে দেখেছি।
এবং তারপর থেকেই আমায় অনুসরণ করছো?
পারিনি; কারণ তুমি অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিলে।
তুমি অত্যন্ত দায়িত্বহীনের মতো কাজ করেছে। রাগ করে লিউক।
ব্রিজেট জিজ্ঞেস করে–কিন্তু তুমি গিয়েছিলে কোথায়?