পাঁচ সাত মিনিট বাদেই ট্রেনটা আস্তে আস্তে ছেড়ে দিলো। লিউক খবরের কাগজ খুলে আকর্ষণীয় সংবাদগুলোতে আবার চোখ বুলোতে আরম্ভ করলো।
কিন্তু লিউক ধরেই নিয়েছে যে, ও বেশিক্ষণ কাগজে মন দিয়ে থাকতে পারবে না। কারণ; ও এই পিসির জাতকে চেনে। ওর অনুমান যে কতখানি সত্যি, কিছুক্ষণের মধ্যেই তা প্রমাণিত হলো। ভদ্রমহিলা সামান্য একটা ছুতো ধরে একেবারে সরাসরি এই ট্রেনের প্রসঙ্গ আরম্ভ করলেন
মাত্র একঘণ্টা দশ মিনিটে আমরা লণ্ডনে পৌঁছে যাবো। কিন্তু তা সত্ত্বেও সকালের ট্রেনে ভীড় বেশি, কারণ এই ট্রেনে দিনের বেলাকার সস্তা টিকিট পাওয়া যায়। আমিও ভেবেছিলাম ঐ গাড়ীতেই যাবো, কিন্তু ওয়াঙ্কিপু–মানে আমার বেড়াল-আজ সকালে ওকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না, আর এই জন্যই তো সকালের ট্রেনে যেতে পারলাম না।
কোনোরকমে লিউক আস্তে আস্তে তা সত্যি বলেই আবার কাগজের ওপর ঝুঁকে পড়লো। কিন্তু তাতেও তার কথার প্রশমন হলো না।
আর এইজন্যই তো আমি সকাল বেলায় না গিয়ে বিকেলের গাড়িতেই যাওয়া ঠিক করলাম। যদিও প্রথম শ্রেণীতে কখনোই বেশি ভীড় হয় না। তা সত্ত্বেও আমি প্রথম শ্রেণীতে সাধারণতঃ যাতায়াত করি না। বুঝতেই তো পারছেন এত রকম করের বোঝা, বাড়িতে লোকজন দিয়ে কাজ করাতে গেলে তিনগুণ বেশি খরচা, অথচ আয়ের পরিমাণ কমে গেছে। যে ব্যাপারটার জন্য এখন আমি যাচ্ছি, সেটা খুবই একটা মারাত্মক ব্যাপার। তাই নিরিবিলিতে বসে একটু ভেবে নিতে চেয়েছিলাম যে পুরো ঘটনাটা বলতে গিয়ে ঠিক কীভাবে বক্তব্য রাখবো
এবার আর না হেসে লিউক পারলো না।
কিন্তু বুঝতে তো পারছেন প্রতিবেশীদের বিপদে-আপদে যদি খানিকটা অতিরিক্ত খরচপত্র হয়েও যায় তা কিছু অন্যায় নয়। তবে আজকাল নোকজন বড় বেশি বাজে খরচ করে।
লিউকের মুখের দিকে চেয়ে ভদ্রমহিলা সঙ্গে সঙ্গে বললেন–যদিও আমি স্বীকার করি যে সামরিক বাহিনীর অফিসারদের প্রথম শ্রেণীতেই যাওয়া উচিত।
লিউক দেখলো একরাশ কৌতূহল নিয়ে ভদ্রমহিলা লিউকের দিকে তাকিয়ে আছেন। উনি কী জানতে চান ও বুঝতে পারলো। ও বললো–আমি কিন্তু সৈনিক নই।
ওহো, আমি বুঝতেই পারিনি–মানে আপনার রংটা বেশ তামাটে কি না, তাই ভাবলাম আপনি হয়তো পূর্বদেশ থেকে সদ্য ছুটিতে এসেছেন।
ওদেশ থেকে এসেছি ঠিকই, লিউক বলে–তবে ছুটিতে নয়, একেবারে দেশে ফিরে এলাম। আমি ওখানে পুলিশে চাকরি করতাম।
কী আশ্চর্য। আপনি পুলিশের লোক? আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর ছেলে প্যালেস্টাইনে পুলিশবিভাগে মাত্র কদিন আগে যোগ দিয়েছে।
আমি ছিলাম মেয়াংস্ট্রেট-এ-লিউক বলল।
আমাদের একই কামরায় একসঙ্গে যাওয়াটা সত্যিই একটা অদ্ভুত যোগাযোগ।
শুধু লিউক বললো–সত্যিই? কিন্তু মনে মনে বললো-লণ্ডন পর্যন্ত পুরো রাস্তাটাই ভদ্রমহিলা ঘড়ির কাঁটার মতো অবিরাম চালিয়ে যাবেন না কি?–ওর মিলড্রেড পিসিও এমনটাই ছিলেন। পিসি ওর ছেলেবেলায় ওর দারুণ প্রয়োজনের সময় ওকে একবার একটা গোটা পাঁচ পাউণ্ডের নোট দিয়েছিলেন। ইংল্যাণ্ডের বাইরে বিদেশে থাকলে এই পিসিদের অভাব যতটা বোঝা যায়, দেশে থাকলে তেমনি এই পিসিদের মাধুর্য ততটা উপলব্ধি করা যায় না।
যাই হোক, তখনও ভদ্রমহিলা স্মিতমুখে তার কথা বলে চলেছেন–
যা বলছিলাম, মানে আমি আজ সকালেই যাব বলে ঠিক করেছিলাম, কিন্তু আপনাকে তো আগেই বলেছি যে আমি ওয়াঙ্কিপুর জন্য খুবই চিন্তায় ছিলাম। আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় আমি যখন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে পৌঁছব, তখন ওঁদের ছুটি হয়ে যাবে? অর্থাৎ ওঁদের কি কোনো বিশেষ সময় নির্দেশ আছে?
জবাবে লিউক বললো–আমার মনে হয় না ওঁরা কোনো বাঁধা ধরা সময় মেনে চলেন।
সে তো নয়ই। মনে করুন, খুন-জখম, চুরি-বাটপাড়ি ইত্যাদি অপরাধগুলো তো আর সময় মেপে হয় না?
লিউক বললো–সেই তো! ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণের জন্য চুপ রইলেন। খানিকবাদে আবার বলতে আরম্ভ করলেন।
আমার সব সময় মনে হয় যে একেবারে উৎস মুখে গিয়ে সন্ধান করা ভালো। জন রীড এমনিতে খুব ভালো লোক, কিন্তু কি জানেন, আমার ধারণা কোনো জটিল অপরাধের কিনারা করার ক্ষমতা ওর নেই। ধারণাই বা বলছি কেন, আমার স্থির বিশ্বাস খুনের কিনারা করার ক্ষমতা ওর নেই।
খুন?–লিউক প্রশ্ন করলো।
উত্তরে ভদ্রমহিলা বললো–হ্যাঁ, খুন। আমি বুঝতে পারছি আপনি আশ্চর্য হচ্ছেন। আমিও প্রথমটায় হয়েছিলাম; এমন কি বিশ্বাস পর্যন্ত করতে পারিনি। ভেবেছিলাম সবই আমার কল্পনা।
লিউক জিজ্ঞেস করে–আপনি ঠিক জানেন তো যে, এ আপনার কল্পনা নয়?
ভদ্রমহিলা জোর দিয়ে বললেন– কক্ষনো না। একটা হলে হয়তো তাই ভাবতাম, কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ–এতগুলো দেখবার পর আমি নিশ্চিত।
লিউক প্রশ্ন করলো-আপনি কি বলতে চান এতগুলো খুন সত্যিই হয়েছে?
বেশ কয়েকটা; আর সেই জন্যই তো ভাবলাম যে সোজা স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে গিয়ে তাঁদের কাছে সব খুলে বলি।
মনে মনে লিউক ভাবলো যে, ইয়ার্ডের লোকজন ঠিক জানে কেমন আচরণ করতে হবে এই ভদ্রমহিলার সঙ্গে। এই বুড়ীদের ঘটনাপঞ্জী শোনবার জন্য হয়তো বা ইয়ার্ডে একটা আলাদা বিভাগই আছে।
লিউক ভাবছিলো, আশ্চর্য! কেন যে এঁদের এমন সব আজ খেয়াল হয়। হয়তো নীরস গ্রাম্য জীবনের একঘেয়েমী–একটা কিছু নাটকীয় করার ইচ্ছা। শোনা যায়, কোনো কোনো বৃদ্ধা এমনও ভাবেন যে, এ বিশ্ব-সংসারে সবাই মিলে তাদের খাবারে বিষ মেশাচ্ছে। লিউকের তগতভাবে বাধা পড়লো ভদ্রমহিলার গলার শান্ত স্বরে–