দুর্ভাগ্য–সৌভাগ্য–এসব মানি। দেখুন না, পরপর কত লোক মারা গেলেন। এই তো মাত্র সেদিন বাবা চলে গেলেন, মিস পিঙ্কারটন গাড়ি চাপা পড়লেন, সেই ছোট্ট ছেলেটা জানলা থেকে পড়ে গেলো; এই সব চোখে দেখে আমার মনে হয় এই জায়গাটার ওপর দুগ্রহ ভর করেছে।
আপনি তাহলে ঘটনাগুলিকে এভাবে দেখছেন?
আমি জানি যে এগুলো বাজে ধারণা; বাবা হয়তো এমনিতেই মারা যেতেন–কিন্তু হঠাৎই চলে গেলেন। তার ওপর আবার মিস পিঙ্কারটনও গেলেন। উনি কয়েকটা কথা বলেছিলেন। –শিউরে উঠলো রোজ আম্বলবি।
উনি কী বলেছিলেন? ভদ্রমহিলা খুব হাসিখুশি স্বভাবের ছিলেন।
রোজ বলল–আপনি চিনতেন? ওঁকে আমার খুব ভালো লাগতো। কিন্তু আমার অনেক সময় সন্দেহ হতো যে ওঁর মাথায় কোনো গণ্ডগোল আছে কি না।
কেন?
কারণ উনি প্রায়ই কতকগুলো অদ্ভুত কথা বলতেন। সর্বদা ওঁর একটা ভয় ছিলো যে, বাবার একটা কিছু বিপদ ঘটবে। আমার কিন্তু মনে হয় মিঃ লিউক যে, ওঁর একটা তৃতীয় চোখ ছিলো; এবং এ থেকেই হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে, বাবার একটা বিপদ-আপদ ঘটবে।
লিউক বলে–কখনো কখনো মানুষ ভবিষ্যৎকে দেখতে পায় এবং ঐ দেখতে পাওয়াটা সব সময়ে ভুতুড়ে কাণ্ড নয়।
আমার তাই মনে হয়।
লিউক বলে–দুশ্চিন্তা করবেন না। যা ঘটার ঘটে গেছে। অতীতের জন্য দুর্ভাবনা করে কোনো লাভ নেই।
তা ঠিক, কিন্তু রোজ ইতস্ততঃ করে বলে–আপনার বোনের জন্য আমার চিন্তা হয়।
আমার বোন? ব্রিজেট?
হ্যাঁ, মিস পিঙ্কারটনও ওকে নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলেন। ব্রিজেটের জীবন নিয়ে ওঁর একটা আতঙ্ক ছিলো।
লিউক ঘাবড়ে গেলো। সেই লোকটার সঙ্গে ব্রিজেট একা আসে। এলসওয়ার্দির কুৎসিত মাংসল হাত দুখানা ওর মানস চক্ষে, ভেসে ওঠে, না না,-এ হতে পারে না। এলওয়ার্দি একজন সাধারণ দোকানদার–কারও ক্ষতি করার মত শক্তি ওর নেই।
বুঝতে পেরে রোজ বললো-এলসওয়ার্দিকে আপনার ভালো লাগে?
একেবারেই না।
জিওফ্রে মানে, ডাঃ টমাসও ওকে পছন্দ করেন না।
আপনি?
আমিও না। দেখলেই কেমন বিকট মনে হয়। শুনেছি ডাইনীদের মাঠেও নাকি কি সব অদ্ভূত পুজো-পার্বণ করে আর তাতে ওর অনেক বন্ধু লণ্ডন থেকে এসে যোগ দেয়। টমি পিয়ার্স ছিলো ওদের একজন চেলা।
প্রশ্ন করে লিউক–টমি পিয়ার্স?
হা!
এসব কবেকার ঘটনা?
অনেক দিন আগের–মনে হয় গত মার্চ মাসের।
এই গ্রামে যা কিছুই ঘটতো, তার সবকিছুর মধ্যেই টমি পিয়ার্স থাকতো।
ও দারুণ কৌতূহলী ছিলো; সব কিছুই ও জানতে চাইতো।
শেষকালে ও বোধ হয় একটু বেশি জেনে ফেলেছিলো–গম্ভীর হয়ে লিউক বললো।
রোজ বললো–ও অতি জঘন্য চরিত্রের ছেলে ছিলো।
তার মানে ওর মৃত্যুতে কেউ খুব একটা দুঃখিত হয়নি?
আমার তো তাই মনে হয়।
শুনেছি তাঁর দুঃখ ভুলবার জন্য আরও ছ-ছজন বিদ্যমান। ভদ্রমহিলার জিভখানা কিন্তু খুব জোরালো।
হা, অত্যন্ত বেশি কথা বলে।
ওঁর দোকান থেকে কটা সিগারেট কিনে এখানকার প্রতিটি লোকের নাড়ি-নক্ষত্র আমার জানা হয়ে গেছে।
রোজ বলে–এ সমস্ত জায়গার এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় দোষ–সবাই সবার সব কিছু জানে।
লিউক বলে–না না, তা হতেই পারে না। একজনের সবটুকু সত্য অন্য আর একজন কখনোই পুরোপুরি জানতে পারে না।
রোজ বলে–সত্যি কথাই বলেছেন।
এমন কি একজনের নিকটতম পরমাত্মীয় সব কথা জানতে পারে না।
রোজ বলে–আপনার কথাই ঠিক; তবে এসব ভয় পাইয়ে দেবার মত কথা আর বলবেন না।
এতে আপনি ভয় পান?
রোজ বললো–পাই। তারপর হঠাৎ বললো–এবার আমায় ফিরতে হবে। আপনার যদি সময় হয়-একবার আমাদের বাড়িতে আসুন না।
তারপর রোজ আম্বলবি চলে গেল।
লিউক বেশ কিছুক্ষণ অপসৃয়মাণ রোজের দিকে তাকিয়ে রইল। বড় একা মনে হলো নিজেকে। কিন্তু ও নিজেকে প্রশ্ন করলো–এই ইচ্ছে আমার হলো কেন? একথা সত্যি যে রোজ আম্বলবি মাত্র অল্প কদিন আগে ওর বাবাকে হারিয়েছে, কিন্তু ওর মা আছে-তা ছাড়া আছে একজন সুদর্শন এবং প্রতিষ্ঠাবান পুরুষও যার বাগদত্তা। তাহলে লিউক ফিৎস্ উইলিয়াম, তোমার এই মহৎ বাসনার কারণ কী? এ কি পুরুষের চিরন্তন রক্ষকের ভূমিকা? কিন্তু আজকাল এটা একেবারেই অচল। ভিক্টোরিয়ান যুগের ভাবধারা এই আধুনিক যুগে আঁকড়ে থাকার নামই অস্বাভাবিকতা।
লিউক নিজেকে বললো–সে যাই হোক, মেয়েটিকে আমার ভালো লেগেছে। টমাসের মত ধূর্ত আর চতুর লোকের পক্ষে ও একেবারেই বেমানান।
তারপর লিউক রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থেমে গেল। লিউক দেখল এলসওয়ার্দি সেই পথেই আসছেন। এলসওয়ার্দি বলল
ও, মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম! নমস্কার, নমস্কার।
প্রত্যুত্তরে লিউক নমস্কার জানিয়ে বলে–প্রাকৃতিক শোভা দেখছিলেন বুঝি?
এলসওয়ার্দি বললো-না না, তা নয়। আমি প্রকৃতিকে সযত্নে এড়িয়ে চলি। আমি সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করি যে প্রকৃতিকে এড়াতে না পারলে কোনো লোকই নিজেকে উপভোগ করতে পারে না।
কিন্তু তা কী করে সম্ভব?
পথ আছে। এমন সুন্দর ছোট্ট জায়গায়ও আনন্দ পাবার মতো বহু রকমের উপায় আছে, আর সেই উপায়ও আমার জানা আছে। আমি জীবনকে উপভোগ করি মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম।
সে তো আমিও করি।
একটা কথা বলি শুনুন। মানুষের চরিত্রে পরিপূর্ণ সুস্থতা এবং স্বাভাবিকতা একটা ভয়ানক রকমের একঘেয়েমী।
কতকটা কুষ্ঠরোগীর বাঁকা চাহনির মতো। যোগ করে লিউক।
খুব ভালো কথা বলেছেন; আপনার বুদ্ধির ধার আছে। সে যাই হোক্, আপনি বেড়াতে বেড়িয়েছেন সুতরাং আপনাকে আর আটকে রাখবো না।