লিউক বললো–ওকে যখন পুলিশ ধরলো, তার আগেই ডজনখানেক খুন নির্ঘাৎ করে ফেলেছিলো।
ডাঃ টমাস বললেন–হ্যাঁ, ওর ব্যক্তিত্বের মধ্যে একটা সহানুভূতি মাখানো ভাব ছিলো। ছেলেমেয়েদের প্রাণ দিয়ে দেখাশোনা করতো; আবার তাদের পর পর মৃত্যুতে একেবারে ভেঙ্গে পড়তো। অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব।
আমার ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে এই সমস্ত লোক কী করে খুনখারাপি করে সেরে যেতে পারে।
খুব একটা আশ্চর্যের কিছু নয়; ব্যাপার খুবই সহজ।–ডাঃ টমাস বললেন।
কী সহজ?
সেরে যেতে পারা।–তারপর হেসে বললেন–কেবল মাত্র যদি সাবধান হওয়া যায়। আসল কথা সাবধান হতে পারাটা। একজন বুদ্ধিমান লোক কখনোই এ সমস্ত ব্যাপারে ভুল করবে না এবং ভুল না করলেই সেরে যেতে পারে।
কথা শেষ করে ডাঃ টমাস ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন।
নিজেকে একজন বুদ্ধিমান লোক ভাবতো লিউক আর ডাঃ টমাসকে ভেবেছিলো সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন একজন লোক। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সেই ধারণা পালটে গেল। ডাক্তারের এ শিশুসুলভ হাসি–কোনো পাকা বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের।
***
মিসেস পিয়ার্সের জবানবন্দী লিউকের ফুটবল খেলার পাতা খুললেই আক্ষেপ হয় যে, একটুর জন্যও একশো কুড়ি পাউণ্ডের বাজিটা জিততে পারলো না। মিসেস পিয়ার্স ওর এইকথায় সহানুভূতি জানিয়ে বলেন যে, তার স্বামীও এভাবে মাঝে মাঝেই নিরাশ হয়ে থাকেন। এইরূপ কথোপকথনের দ্বারা দুজনের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
মিসেস পিয়ার্স বলেন–মিঃ পিয়ার্স ফুটবল খেলায় একজন অদম্য উৎসাহী, আর যেমন বললাম –বহুবার হতাশও হয়েছেন। তবে কপালে না থাকলে জেতা যায় না।
লিউকও এই কপালতত্ত্বে আন্তরিক সায় দিয়ে বলে–যখন আসে তখন কষ্ট দুঃখ সব একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে আসে।
কথার মতো একটা কথা বলেছেন–আমি মর্মে মর্মে একথা জানি। মিসেস পিয়ার্স বলেন–বিশেষ করে যে মহিলার স্বামী আর আট ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘর আর আটটির মধ্যে দুটিই কবরের তলায়–সে কথা ভালো করেই জানে।
লিউক বলে–সে তো জানবেই। আপনার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে দুজনই বুঝি মারা গেছে?
মিসেস পিয়ার্স বলেন–একটি তো মাত্র এই মাসখানেক আগেই গেল।
আহা, বড়ই দুঃখের ব্যাপার তো?
শুধুই দুঃখের কী বলছেন? কী যে দারুণ আঘাত পেয়েছিলাম। টমি যে এভাবে চলে যাবে, একথা ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করিনি। বেঁচে থাকতে ও আমায় অনেক জ্বালিয়েছে, কিন্তু এভাবে চলে গেল?
সমবেদনা জানিয়ে লিউক প্রসঙ্গটা ভালো মেয়ে এমা থেকে টমিতে সরিয়ে আনলো।
আপনার ছেলে বুঝি অল্পদিন আগেই মারা গেছে?
হ্যাঁ, একটা দুর্ঘটনা ঘটলো–যে বাড়িতে আমাদের লাইব্রেরি–সেই বাড়ির জানলা সাফ করছিলো। আর পা হড়কে সেই উঁচু থেকে পড়ে গেল।সেই দিনকার ঘটনার বর্ণনা দেন মিসেস পিয়ার্স।
লিউক জিজ্ঞেস করে–আচ্ছা, কেউ কি একথা বলেছে যে, ওকে জানলার আলসেতে দাঁড়িয়ে নাচানাচি করতে দেখা গেছে?
মিসেস পিয়ার্স বললেন–অল্পবয়সী ছেলেরা বয়স অনুযায়ীই আচরণ করবে; তাই নিয়ে খুঁত খুঁতে স্বভাবের মেজর হর্টন অত হৈ চৈ না করলেই পারতেন।
মেজর হর্টন?
হ্যাঁ, এক দঙ্গল কুকুর নিয়ে ভদ্রলোক থাকেন। দুর্ঘটনা ঘটার পর উনি বলেন যে টমি খুব অসাবধান ছিলো; কিন্তু আমার মন বলে যে ও নিশ্চয়ই হঠাৎ কিছু একটা দেখে এতই চমকে উঠেছিলো যে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়। তবে এই বয়সের ছেলেরা এমনটা তো হয়ই–কিন্তু ওর মনটা খারাপ ছিলো না।
না না, সে তো ছিলোই না; তবে কথা কি জানেন মিসেস পিয়ার্স? আমরা এই মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকেরা প্রায়ই ভুলে যাই যে আমরাও একদিন ছোটো ছিলাম।
একটু হেসে লিউক জিজ্ঞেস করে–যাদের কাছে কাজ করতো তাদের সঙ্গে বুঝি দুষ্টুমি করতো?
মিসেস পিয়ার্স উত্তর দেন-ও তাদের নিয়ে একটু মজা করতো-ব্যস এইটুকুই। আমাদের হাসাবার জন্য ও কখনও বা মিঃ এলসওয়ার্দির কখনও বা চার্চের পরিচালক মিঃ হবসের গলার নকল করতে তাদের মতো কথা বলতো। আবার কখনও বা বাগানের মালীদের কাছে গিয়ে খোদ লর্ডের অনুকরণ করে ওদের হাসাতো। এজন্যই তো লর্ড ওকে ছাঁটাই করেছেন; তবে ওর ওপর কোনো রাগ-বিদ্বেষ ছিলো না। পরে লর্ড নিজেই ওকে আর একটা চাকরি যোগাড় করে দিয়েছিলেন।
কিন্তু আর কেউ ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতো না?
না তা করতো না। কারও নাম করা উচিত নয়; তবে যেমন ধরুন মিঃ অ্যাবট সবার সঙ্গেই খুব ভালো ব্যবহার করেন; ওঁকে নিয়ে কথা বলা উচিত নয়।
টমি কি ওঁর সঙ্গে কোনো ঝামেলায় পড়েছিলো।
মিসেস পিয়ার্স বলেন–ঠিক তা নয়, তবে কথা হচ্ছে যে, যেসব কাগজপত্র খুব প্রয়োজনীয় এবং গোপনীয়, তেমন কাগজপত্র টেবিলের ওপর না রাখাই ভো উচিত–অন্ততঃ আমি তো তাই বুঝি।
লিউক বলে–সে তো নিশ্চয়ই।
খুব খাঁটি কথা। আমারও ওই একই কথা; মিঃ পিয়ার্সও এই কথাই বলেন। টমি কিন্তু সেইসব কাগজপত্র পড়েও দেখেনি।
আচ্ছা, ওগুলো কী ছিলো? উইল?
না না, ওসব নয়। তেমন কিছু দরকারী কাগজ নয়–একটা ব্যক্তিগত চিঠি, একজন মহিলার লেখাটমি নামটা পর্যন্ত দেখেনি। তাইতো বলি, তুচ্ছ একটা ব্যাপার নিয়ে এতটা হৈচৈ না করলেই হতো।
মিঃ অ্যাবট বুঝি সহজেই সব কিছুতে দোষ ধরেন? লিউক জিজ্ঞেস করে।
তাই তো মনে হয়। শুনেছি ভদ্রলোকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করাটা বেশ শক্ত। এই তো দেখুন, ডাঃ আম্বলবির সঙ্গে দারুণ খটাখটি ছিলো, দুজনের সম্পর্ক ছিলো যেন একেবারে সাপে-নেউলে। কিন্তু এখন যদি মিঃ অ্যাবটের সেই সমস্ত কথা মনে পড়ে, তাহলে নিশ্চয়ই ওঁর খুব খারাপ লাগবে কারণ, মারা গেলে তার ওপর আর রাগ বিরক্তি দেখাতে নেই; অথচ দেখুন, রূঢ় কথা একবার বলে ফেললে তা তো আর ফেরত নেওয়া যায় না।