তা তো হবার নয় ইভানস, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, আমাদের তদন্তের কাজ যতদিন না শেষ হচ্ছে ততদিন যেখানে যা কিছু যে অবস্থায় আছে ঠিক সেই অবস্থায় রাখতে হবে, কিছু সরানো বা এদিক ওদিক করা চলবে না।
ঠিক আছে স্যার,ইভানস ঘাড় নেড়ে বলল, আপনি যখন বলছেন তখন তাই হবে।
আমি চারপাশে সবকিছু একবার ভাল করে দেখে নিই ইভানস, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি বরং অপেক্ষা করো, দরকার হলে তোমায় পরেও কিছু প্রশ্ন হয়তো করতে হতে পারে।
তাই হবে স্যার।
ইভানসের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট এবার টেবিলের দিকে তাকালেন। রাতের খাবার টেবিলের ওপর খাবার সাজিয়ে রেখেছে ইভানস মোষের সেদ্ধ করা জিভ, চাটনি, পনীর, বিস্কুট, এছাড়া টেবিলের পাশেই গ্যাস উনুনের ওপর রাখা ডেকচিতে টগবগ করে ফুটছে স্যুপ। সাইডবোর্ডে সাজানো রয়েছে সোডার বোতল, গ্লাস আর দু বোতল বিয়ার। একপাশে ছোট একটি মীট সেফের ওপর থাকে থাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে এক প্রস্থ রূপোর কাপ-ডিস, তাদের পাশে শোভা পাচ্ছে তিনটে উপন্যাস, একদম আনকোরা।
উপন্যাস তিনটে হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, তাদের নাম–প্রেম যেখানে শেষ কথা, লিংকটের ফুর্তিবাজেরা, প্রেমের বন্দী।
ক্যাপ্টেন নারীবিদ্বেষী হলেও বাছাই করার ব্যাপারে খুব রসিক পুরুষ ছিলেন দেখছি, চাপা গলায় মন্তব্য করলেন তিনি।
চাপাগলায় মন্তব্য করলেও ইভানসের কান এড়াল না, সে বলল, ভুল করলেন স্যার, পড়ার জন্য নয়, ক্যাপ্টেন ওই তিনটে বই একটা নামকরণ প্রতিযোগিতায় জিতে পুরষ্কার পেয়েছিলেন। এই বই তিনটি কোনোদিন ওঁকে পড়তে দেখিনি, পাতাও উল্টে দেখেননি।
খাবার ঘরখানা আকারে মাঝারি, এককোণে একটি আলমারি, তার সামনে এসে দাঁড়ালেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট। সার্জেন্ট পোলক এতক্ষণ তার পাশেই ছিলেন, একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি তিনি, এবার ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের অনুমতি নিয়ে তিনি আবার ফিরে গেলেন স্টাডিতে যেখানে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হয়েছিলেন।
আলমারির সামনে এসে দাঁড়াতে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট দেখতে পেলেন এক জোড়া স্কি, মাছ ধরার ছিপ, গলফ খেলার সরঞ্জাম, আর শিকার করার কিছু অত্যাবশ্যক সাজসরঞ্জাম ভেতরে শোভা পাচ্ছে। হাতির কেটে নেয়া পদ্মের পাতার মতো কান, জলহস্তীর চোয়াল, আর একটা চিতাবাঘের চামড়াও তার চোখে পড়ল। শুধু নারী বিদ্বেষী নয়, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান যে সর্বার্থে একজন খাঁটি পুরুষ ছিলেন এইসব দেখে সে সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হচ্ছিলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।
আচ্ছা ইভানস, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন, সিটাফোর্ড হাউস তো মাস কয়েকের জন্য মিসেস উইলেটকে ভাড়া দিয়েছিলেন কাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান, তাই না?
হ্যাঁ স্যার, ইভানস বলল, আপনি ঠিকই শুনেছেন?
তাহলে খামোকা এসব জিনিস উনি এতদূরে এই ভাড়াবাড়িতে বয়ে আনলেন কেন? সিটাফোর্ড হাউসেই তো রেখে দিতে পারতেন?
সেটা আপনি বোঝেন, আমিও বুঝব, কিন্তু ক্যাপ্টেনকে বোঝাবে কে? ইভানসকে কিছুটা বিরক্তি মেশানোর গলায় বলল, ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে এসব জিনিস এতদূর বয়ে নিয়ে আসা কি কম ঝক্কি? ক্যাপ্টেনকে বহুবার বলেছি কিন্তু উনি কিছুতেই বুঝবেন না, বারবার বলতেন, ইভানস, যাকে বাড়ি ভাড়া দিয়েছি সে মেয়েমানুষ, আর আমার এইসব সাধের জিনিসের মর্ম বোঝ কোনো মেয়েমানুষের কর্ম নয়, আলমারির কাঁচ ভেঙ্গে চুরে সবকিছু ছড়িয়ে তছনছ করবে। তাই ওগুলো এখানে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। আলমারির ভেতরে যা কিছু দেখছেন ক্যাপ্টেন ওগুলোকে নিজের ছেলেমেয়ের মতো ভালোবাসতেন।
আচ্ছা ইভানস,ইচ্ছে করেই ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রসঙ্গ পাল্টালেন, সিটাফোর্ড হাউস ট্রেভিলিয়ান যাকে ভাড়া দিয়েছিলেন, সেই মিসেস উইলেটের সঙ্গে ওঁর কি আগেই পরিচয় ছিল?
না স্যার,ইভানস বলল, উইলিয়ামসনস নামে একটা বড় কোম্পানি আছে যারা জমি আর বাড়ির দালালী করে, মিসেস উইলেট ওদের মাধ্যমেই এসেছিলেন।
বাড়িটা ভাড়া নেবার আগে ওঁদের দুজনের দেখাসাক্ষাৎ হয়নি?
তা হয়েছিল বৈকি, মিসেস উইলেট বাড়ি দেখতে এলেন তখন ক্যাপ্টেনের সঙ্গে ওঁর পরিচয় হল।
আজ্ঞে ঠিক তাই।
ক্যাপ্টেনের সঙ্গে মিসেস উইলেটের সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল কি?
হ্যাঁ স্যার, ইভানস বলল, ভদ্রমহিলা ক্যাপ্টেনের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছিলেন।
আর তোমার মনিব?
স্যার, আমার মনিব ছিলেন এক পোড়খাওয়া জাহাজী,ইভানস মুখ টিপে হাসল, ওঁর মতো লোককে পটানো মিসেস উইলেটের কম্মো ছিল না। কিন্তু তাই বলে আমার মনিব কোনোদিন মিসেস উইলেটের সঙ্গে অভদ্রতা বা খারাপ ব্যবহার করেননি, তবে মিসেস উইলেট যখনই ওঁকে খাবার নেমতন্ন করতো ক্যাপ্টেন কোনো না কোনো ছুতোয় ঠিক তা এড়িয়ে যেতেন।
কেন, কোন উদ্দেশ্যে মিসেস উইলেট প্রায়ই কাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খাবার নেমতন্ন করতেন? নিজের মনে নিজেকে প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, ভদ্রমহিলা কি কাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের অংশটা পাকাপাকিভাবে দখল করতে চেয়েছিলেন যার পরিণতিতে শেষপর্যন্ত খুন হতে হল তাকে? হয়তো ভদ্রমহিলা ধরে নিয়েছিলেন খুব ঘনিষ্ট হবার পরে তিনি বাড়ির একটা অংশ নিজে কিনে নেবেন আর ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান তারপর বাকি জীবনটুকু তার বন্ধু মেজর বারনাবির বাড়িতে তারই সঙ্গে ভাগাভাগি করে কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু পরক্ষণেই ন্যারাকটের মনে পড়ল যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ভয়ানক বৈষয়িক লোক ছিলেন, প্রাণ গেলেও সিটাফোর্ড হাউসের তাঁর অংশটুকু তিনি কাউকে বিক্রি করবেন না, আর একজন মহিলাকে তো নয়ই।