মেজর বারনাবি আর ডঃ ওয়ারেনকে সঙ্গে নিয়ে কনস্টেবল গ্রেভস এসে হাজির হলেন হ্যাজেলমুরে, কলিংবেল টিপে আর কড়া নেড়েও কোনো ফল হল না।
বাড়ির পেছনদিকে একবার চলুন, ডঃ ওয়ারেন প্রস্তাব দিলেন, দেখা যাক ওদিক দিয়ে ভেতরে ঢোকা যায় কিনা।
বাড়ির পেছন দিকে এসে পৌঁছোনোর পর হঠাৎ তাদের নজরে পড়ল ট্রেভিলিয়ানের স্টাডির একটা জানালা খোলা। সেই ভোলা জানালা দিয়ে প্রথমে মেজর বারনাবি, তারপর কনস্টেবল গ্রেভস আর সবশেষে ডঃ ওয়ারেন ভেতরে ঢুকলেন। স্টাডির ভেতরে চরম বিশৃঙ্খলার চেহারা লক্ষ্য করলেন তারা। বই, খাতা, কাগজপত্র, দলিল সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। মেঝের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছেন বিশালদেহী ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান, তার হাতদুটো দুপাশে ছড়ানো, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের দেহের পাশে গাঢ় সবুজ রংয়ের একটা ধাতব টিউব পড়ে আছে। ডঃ ওয়ারেন হাঁটু গেড়ে বসে তার নাড়ী আর হৃৎপিন্ডের গতি পরীক্ষা করলেন, কয়েক সেকেন্ড বাদে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
উনি কি মারা গেছেন? মেজর বারনাবি প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ, ঘাড় নেড়ে সংক্ষেপে উত্তর দিলেন ডঃ ওয়ারেন, কনস্টেবল গ্রেভসের দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন আপনি বলুন আমি কি করব? আপনার ওপরওয়ালা ইন্সপেক্টর সাহেব যতক্ষণ না এসে পৌঁছোচ্ছেন ততক্ষণ এই লাশ পরীক্ষা করাও আমার পক্ষে উচিত হবে না। তবে মৃত্যুর কারণ কি তা বলছি, খুলির গোড়ার হাড় ভেঙ্গে যাবার ফলে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃত্যু হয়েছে, আর মনে হচ্ছে ওই জিনিসটা দিয়েই ওঁর মাথায় আততায়ী জোরে আঘাত হেনেছে, বলে ডঃ ওয়ারেন মৃতদেহের পাশে পড়ে থাকা সবুজ রংয়ের ধাতব টিউবটা ইশারায় দেখালেন।
আততায়ী! ভীতি মেশানো সুরে কনস্টেবল গ্রেভস বলে উঠলেন, তার মানে ডাক্তার, আপনি বলছেন এটা খুন? ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খুন করা হয়েছে?
ডঃ ওয়ারেন কোনো উত্তর না দিয়ে নীরবে শুধু ঘাড় নাড়লেন।
ডাক্তার, মেজর বারবি ডঃ ওয়ারেনকে প্রশ্ন করলেন, কতক্ষণ আগে ওঁর মৃত্যু ঘটেছে তা বলতে পারেন?
তা কম করে দু-তিন ঘণ্টা তো বটেই, ডঃ ওয়ারেন জবাব দিলেন, আমার হিসাবে তাই দাঁড়াচ্ছে।
প্রায় দু-তিন ঘণ্টা? হায় ঈশ্বর! আক্ষেপের সুরে বলে উঠলেন মেজর বারনাবি, তারপর তার বন্ধুর মৃতদেহের পাশেই একটা চেয়ারে বসে পড়লেন, নিজের মনে বিড়বিড় করে বললেন, তাহলে সময় দাঁড়াচ্ছে বিকেল প্রায় পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিট। হা ঈশ্বর। তাহলে আজ বিকেলে ওখানে প্রেতচক্রে যা ঘটেছিল সে সবই সত্যি।
.
০৪.
ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের স্টাডিটা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে মুখ তুলে একবার আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের দায়িত্ব অর্পন করেছেন তার ওপর, সেই দায়িত্ব পালন করতে ন্যারাকট ছুটে এসেছেন সুদূর এক্সটার থেকে, তাকে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তদন্তের কাজে সাহায্য করবেন সার্জেন্ট পোলক।
স্টাডির খোলা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট। বাইরে যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু চোখে পড়ে ধপধপে সাদা ঘন তুষারের স্তর, তার ওপর ঝলসাচ্ছে শীতের সূর্যকিরণ। জানালা থেকে প্রায় একশো গজ দূরে একটা ছোট কাঠের বেড়া দেখা যাচ্ছে, তার কিছুটা দূরেই পাহাড়ে ওঠার খাড়া চড়াই পথ শুরু হয়েছে। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃতদেহ এখনও পড়ে আছে স্টাডিতে। নৌবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নেবার পরেও ট্রেভিলিয়ান নাবিকদের ধাঁচের মতো চাপদাড়ি রাখতেন, লম্বাটে মুখে চিবুকের কাছে দাড়িটা ছুঁচলো হয়ে গেছে। ট্রেভিলিয়ানের বয়স হয়েছিল। প্রায় ষাট, কিন্তু দেখলে মনে হত তিনি সবে পঞ্চাশের কোঠায় পা দিয়েছেন। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট নিজে এখনও খেলাধুলা করেন। ট্রেভিলিয়ানের চড়া কাধ, পেশীবহুল অথচ মেদহীন শরীর দেখে তিনি বুঝতে পারলেন তিনিও খেলাধুলার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন।
ব্যাপারটা ভারি অদ্ভুত ঠেকছে, বলে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট তাকালেন সার্জেন্ট পোলকের দিকে, এই খুন সম্পর্কে আপনার ধারণা কি বলুন, শুনি।
ইয়ে–বারকয়েক মাথা চুলকালেন সার্জেন্ট পোলক, তারপর বেশ হুঁশিয়ার ভঙ্গিতে মন্তব্য করলেন, ইয়ে স্যার, আমার মনে হয় ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান যখন ওপর তলায় ছিলেন ঠিক সেই সময় আততায়ী বাইরের থেকে জানালা খুলে ভেতরে ঢোকে, তারপর ঘরের জিনিসপত্র তছনছ করতে থাকে। ভেতরে কাউকে দেখতে না পেয়ে ও নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছিল যে বাড়িতে কেউ নেই।
হুম, নাক দিয়ে শব্দ করে গম্ভীরগলায় ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের শোবার ঘরটা কোথায়?
আজ্ঞে ওপরতলায়, স্যার বিনীত ভঙ্গিতে সার্জেন্ট পোলক জানালেন, এই ঘরের ঠিক ওপরে।
এখন রোজই বিকেল প্রায় চারটে নাগাদ সন্ধ্যে হচ্ছে, ন্যারাকট আবার বললেন, আমার ধারণা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান যদি সত্যিই সেইসময় ওপরে থাকতেন, তাহলে ওই ঘরের আলো নিশ্চয়ই জ্বলত, আর জানালার কাছে আসবার সময় বাইরে থেকে তা আততায়ীর চোখে ঠিকই পড়ত।
আজ্ঞে আপনি বলতে চাইছেন যে সে অপেক্ষা করত, তাই না?
যে বাড়ির কোনো ঘরে আলো জ্বলে সেখানে বাইরে থেকে কোনো আততায়ী জানালা দিয়ে চুরি করতে বা খুন করতে ভেতরে ঢোকে না। যাক, তারপর কি ঘটেছিল বলে আপনি মনে করেন?