সবকিছু নির্দিষ্ট আইন ধরেই চলবে। এই কথা ভাবতে ভাবতেই তার দুই চোখ জুড়ে ঘুমের খোলা বন্য নেমে এলো। সকালেও কিন্তু তরুণ সূর্যের সপ্তরঙ উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো না।
ঘন মেঘে সমাচ্ছন্ন হয়ে রইলো সারা আকাশ। তার সঙ্গে শুরু হলো অবিশ্রান্ত তুষারপাত। জিলের মুখচোখ গম্ভীর হয়ে উঠলো। মলির মুখে ব্যাপ্ত হলো বিষাদের মলিনতা।
সমস্ত আবহাওয়াটাই যেন তাদের এক ভয়াবহ প্রতিকূল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় ট্যাক্সিতে চেপেই মিসেস বয়েল হাজির হলেন।
তুষার কেটে পথ চলার জন্যে এই ট্যাক্সির চাকাগুলোয় বিশেষ এক ধরনের চেন লাগানো থাকে।
ট্যাক্সিড্রাইভারও রাস্তাঘাটের বিপর্যস্ত অবস্থার আশঙ্কাজনক বর্ণনা দিল। এই তুষারপাত বন্ধ হবার আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রকৃতি দেবী কবে যে শান্ত হবেন একমাত্র ঈশ্বরই তা বলতে পারেন। গম্ভীর কণ্ঠে ভবিষ্যৎবাণী করলো ড্রাইভার।
মিসেস বয়েল নিজেও এই বিষাদ বিধুর পারিপার্শ্বিকের মাঝখানে কোনোরকম উজ্জ্বলতার দীপ্তি ফোঁটাতে পারবেন না। তার আকৃতি বেশ লম্বা চওড়া দশাসই ধরনের, দেখলেই বুকের মধ্যে গুরগুর করে ওঠে, কণ্ঠস্বরও বেশ চড়া আর কর্কশ।
আচার আচরণ পুরুষালি ঢঙের। রীতিমতো দাপটের সঙ্গে আশেপাশের সবকিছুকে দাবিয়ে রাখাই যেন তার সহজাত অভ্যাস।
যদি আমি এটা একটা চালু প্রতিষ্ঠান বলে ধারণা না করতাম, তাহলে কখনোই এখানে আসতে রাজী হতাম না।
বেজার কণ্ঠে শুরু করলেন তিনি। স্বাভাবিক ভাবেই আমি ভেবে ছিলাম নিশ্চয় কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত অতিথিশালা।
যথারীতি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই হোটেল পরিচালিত হয়, আপনাকে যে এখানে থাকতেই হবে তারও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ক্ষোভের সুরে জবাব দিল জিল। যদি জায়গাটা আপনার সত্যিই মনে না ধরে তবে অনায়াসে অন্যত্র চলে যেতে পারেন।
সে তো অবশ্যই।
আমার পছন্দ না হলে থাকতেই বা যাবো কেন? হোটেলের কি কোনো অভাব আছে দুনিয়ায়?
আবার মুখ খুললো জিল, আমার মনে হয়, মিসেস বয়েল, আপনার জন্যে কোনো ফিরতি ট্যাক্সির বন্দোবস্ত করে দিলেই আপনি সব থেকে স্বস্তিবোধ করেন।
রাস্তাঘাট এখনো সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়নি। যদি প্রকৃতই কোনো ভুল বোঝাবুঝি ঘটে থাকে। তবে বেশিদূর গড়াতে দেবার আগেই, তার প্রতিকারের চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয়।
একটু থেমে বাকিটা শেষ করলো জিল, এত বেশি আবেদন পত্র আমরা পেয়েছি যে আপনার জন্যে নির্দিষ্ট ঘরটা অন্য কাউকে বন্দোবস্ত করে দিতেও আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না।
তাছাড়া অদূর ভবিষ্যতে আমাদের ঘরের দৈনন্দিন ভাড়া কিছুটা বাড়িয়ে দেবো ঠিক করেছি।
মিসেস বয়েল জিলের দিকে এক ঝলক ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।
সে দৃষ্টিতে খরতর দহনের দীপ্তি।
এখানকার রীতিনীতি ভালো করে বুঝে না নিয়েই আমি অন্য কোথাও উঠে যাবার চেষ্টা করছি না–দয়া করে এ কথাটাও স্মরণ রাখবেন।
আর হ্যাঁ, স্নান ঘরে আমার জন্যে বড়সড় তোয়ালের বন্দোবস্ত করে দেবেন।
রুমালের মতো ছোট সাইজের তোয়ালে দিয়ে গা মুছতে আমি আদপেই অভ্যস্ত নই।
মিসেস বয়েল সামনের দিকে কয়েক পা অগ্রসর হবার পর জিল মলির দিকে তাকিয়ে চোখ মটকালো।
সত্যিই জিল, তুমি অদ্ভুত।
চাপা খুশিখুশি কণ্ঠে মলি বললো, যে ভাবে তুমি পরিস্থিতির হাল ধরলে.., ভদ্রমহিলার মুখে আর কথাটি নেই। একবারে ফাটা বেলুনের মতোই চুপসে গিয়েছে।
ঠিকমতো দাওয়াই পড়লে সব ফোঁস-ফাসই ঠান্ডা হতে বাধ্য। মন্তব্য করলো জিল।
আমি ভাবছি, মলির কণ্ঠে নতুন করে আশঙ্কার সুর ঘণীভূত হলো, ক্রিস্টোফার রেনকে ভদ্রমহিলা কি ভাবে গ্রহণ করবেন?
তিনি যে সুনজরে দেখবেন না–এ কথা বলাই বাহুল্য। জিলের ধারণা যে কত অভ্রান্ত সেদিন বিকেলেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল।
ভদ্রমহিলা মলিকে ডেকে বললেন, ভদ্রলোকের চালচলন কেমন যেন কিম্ভুত প্রকৃতির। তার রীতিমতো বিরক্তির সুর সহজে কানে বাজে। রুটি বিক্রেতা যখন রুটি দিতে এলো তখন তার চেহারা দেখে মনে হলো যেন কোনো মেরু অভিযাত্রী। এবং আগামী দুচার দিন তার পক্ষে হয়তো আর রুটিন মাফিক রুটি ফেরি করা সম্ভব হবে না সে কথাও সবিনয়ে জানিয়ে দিলো।
চারদিকের রাস্তাঘাট বরফ পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে, ঘোষণা করলো লোকটি।
ভালো চান তো এই বেলা বেশি পরিমাণ পাঁউরুটি ভাঁড়ারে মজুত করে রাখুন।
হ্যাঁ, নিশ্চয়।
মলিও মাথা নেড়ে সায় দিলে সে প্রস্তাবে। এখানে খালি টিনের অভাব নেই।
রাখবার কোনো অসুবিধে হবে না। তুমি বরং কিছু বেশি পরিমাণেই দিয়ে যাও। যদি সত্যিই সেরকম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় তবে শুধু পাঁউরুটির সাহায্যে কি কি খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত করা যায় আপনা থেকে সে চিন্তাও তার মাথার মধ্যে উদয় হলো। সঙ্গে সঙ্গে তার একটা তালিকার মনে মনে প্রস্তুত করে নিল মলি।
দৈনিক খবরের কাগজটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল রুটিওলা কাগজটা টেবিলের ওপর রেখে একবার চোখ মেলল। সবকটি পররাষ্ট্রের নীতিই সবার আগে প্রাধান্য পেয়েছে। মোটামোটা হরফে হেডিং-এর নিচে বিস্তারিত ভাবে সরবরাহ করা হয়েছে সেই সমস্ত কূটকচালি ইত্যাদি। তারপর আবহাওয়ার খবর। প্রথম পাতার নিজের দিকে নগ্ন ছবিসহ মিসেস লিয়নের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সম্পূর্ণ বিবরণ।