তাই হয়তো হবে তবে নিশ্চিত কোনো প্রমাণ পাবার আগে এই রকম ভদ্র ভাষাই প্রয়োগ করা বিধেয়। ঝনঝনিয়ে কলিংবেল বেজে উঠলো।
সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠলো দুজনে। সদর দরজার বেল বাজছে। জিল বললে, এখন একজন মুনীর অনুপ্রবেশ! রহস্যময় ভঙ্গিতে শেষ করলো কথাটা।
হ্যাঁ, এটা কোনো নাটকের দৃশ্য হলে সেই রকমই ঘটতো!
মন্তব্য করলো মলি।
তাড়াতাড়ি চল, বোধহয় মিঃ রেন এসেছেন। এখন দেখা যাক কার কথা শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়। তোমার না আমার।
এক ঝলক তুষারের সঙ্গে সঙ্গে মিঃ রেন ভেতরে ঢুকলেন।
লাইব্রেরীর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মলি তাকে স্পষ্ট করে দেখতে পেলো না। শুধু বাইরের রুপোলি তুষারের পটভুমিকায় একজন অচেনা ব্যক্তির কালো অবয়বটুকুই সে প্রত্যক্ষ করলো।
সভ্য মানুষের পোশাক-আশাক সর্বদাই কেমন একই রকমের হয়।
মনে মনে চিন্তা করলো মলি।
কালো ওভার কোট, মাথায় ধুসর রঙের টুপি। গলায় জড়ানো পশমের মাফলার।
মিঃ রেন ভেতরে প্রবেশের পর জিল আবার সদর দরজাটা বন্ধ করে দিল।
পোশাক পরিচ্ছদের ওপর থেকে ব্যস্ত হাতে তুষার ঝাড়তে লাগলেন রেন।
হাতে ধরা স্যুটকেসটার ওপর পুরু হয়ে তুষার জমে আছে। সেগুলোও ঝেড়ে ঝেড়ে মাটিতে ফেলে দিলেন। সেই সঙ্গে বকে চললেন এক নাগাড়ে। তার গলার স্বর কিছুটা সরু ও তীক্ষ্ণ। দূর থেকে শুনলে মনে হয় কেউ যেন ঝগড়া করছে।
আলোয় আসতে দেখা গেল ভদ্রলোক এখনো যুবক।
রোদে পোড়া তামাটে চুল। ছোট ছোট চোখে জ্বলজ্বলে অশান্ত দৃষ্টি।
কি ভয়াবহ, কি সাংঘাতিক আবহাওয়া! অসুখী কণ্ঠে বিড়বিড় করলেন তিনি। শীতকালীন ইংলণ্ডের এমন চরম দপ আর কখনো দেখা যায়নি।
মনে হয় যেন ভিকেন্সের সে বিখ্যাত ক্রিস্টমাসের বর্ণনাকে ছাপিয়ে গেছে। বাইরে দাঁড়িয়ে এর ধকল সামলানো সহজ কথা নয়।
আপনারাও নিশ্চয় তা স্বীকার করবেন? আমাকে ওয়ে থেকে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এখানে আসতে হয়েছে। আপনিই কি মিসেস ডেভিস?
বাঃ–খুবই চমৎকার!
দ্রুত হাত বাড়িয়ে মলির সঙ্গে করমর্দন করলেন তিনি।
আমি কিন্তু মনে মনে আপনাকে যেভাবে কল্পনা করেছিলাম বাস্তবের সঙ্গে কোনো মিল নেই তার। ভেবেছিলাম ভারত প্রত্যাগত সেনাবাহিনীর কোনো অধিনায়কের বিধবা স্ত্রী বা ওই জাতীয় কেউ হবেন। আচার ব্যবহারও একেবারে খাঁটি মেমসাহেবের মত কড়া আর রাশভারী। পান থেকে চুন খসলেই মুস্কিল। কিন্তু এখন আপনাকে দেখে খুব আনন্দ হচ্ছে আমার। কেমন একটা স্বর্গীয় মনোরম পরিবেশ মনে হচ্ছে। আপনি কি মোমের তৈরি রংবেরঙের ফুল দিয়ে সাজিয়ে রেখেছেন ঘরদোর। অথবা স্বর্গের পাখিদের খাঁচায় ভরে বাগানে রেখে দিয়েছেন? যদিও তার প্রয়োজন ছিল না, কারণ এমনিতেই আমার জায়গাটা খুব ভালো লেগেছে। আমার ধারণা ছিল এটা হয়তো ভিক্টোরিয়ান যুগের কোনো জরাজীর্ণ সাবেকী প্রাসাদ। কড়ি-বরগা জানলা সব খুলে খুলে পড়ে যায়। কিন্তু ভেতরে পা দিয়ে আমার ধারণা সম্পূর্ণ পালটে গেছে। বাড়িটার অবস্থা তো বেশ ভালোই, উপরন্তু হাল আমলের যাবতীয় সুখ সুবিধেরও ব্যবস্থা আছে এখানে। আচ্ছা শোবার ঘরে নিশ্চয় বনেদী আমলের মেহগনি কাঠের পালঙ্ক পাতা আছে। — যার গায়ে নানা রকমের ফুল-পাতা লতাপাতার ছবি থাকে আঁকা?
একটু ফাঁক পেয়ে মলি বলল, সত্যি কথা বলতে কি আমাদের অতিথিদের জন্য বিলাসবহুল মেহগনি খাটের বন্দোবস্ত করে রেখে দিই।
বিস্ময় মেশানো সুরে তিনি বলে উঠলেন–তাই নাকি? কি আশ্চর্য! দয়া করে একবার দেখাবেন আমায়?
ভদ্রলোক এত ব্যগ্রস্বরে কথাটা বলে উঠল যে মলি কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেল। ইতিমধ্যে দরজার হাতল ঘুরিয়ে ডাইনিং হলের মধ্যে মিঃ রেন পা দিয়েছেন।
নিজের হাতে তিনি সুইচ টিপে আলো জ্বালালেন। মলি তার পেছন পেছন চলল। পিছনে ফিরে দেখল জিল বিরক্তি মুখে বসে আছে।
মিঃ রেন ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে লাগল ঘরের আসবাবপত্রগুলো। অবশেষে ঈষৎ অভিযোগের সুরে সে মলিকে বলল–কিন্তু বনেদী ধাঁচের বড়সড় ডাইনিং টেবিল তো দেখতে পাচ্ছি না। তার বদলে আধুনিক ফ্যাশানের এই ছোট টেবিল পাতলেন কেন?
নিরাসক্ত সুরে মলি জবাব দিল, আমাদের মনে হল, আজকালকার লোকেরা এই ধরনের ডাইনিং টেবিলই বেশি পছন্দ করে।
রেন ডাইনে-বাঁয়ে ঘাড় দুলিয়ে বলল, তা অবশ্য ঠিক! আমি আমার নিজের স্বপ্নেই বিভোর। শুধুমাত্র মেহগনির টেবিল থাকলেই চলে না, টেবিলের চারপাশের বনেদী সম্ভ্রান্ত পরিবারের জমকালো উপস্থিতিরও একটা প্রয়োজন। বিরাট একটা চেয়ার জুড়ে পরিবারের কর্তা বসে থাকবেন। তার গালে সাদা দাড়ি। লম্বা চওড়া চেহারার মানুষ হবেন তিনি। পাশের চেয়ারে মূর্তিমতী করুণার প্রতীক থাকবেন তার স্ত্রী। তাদের আশেপাশে তাদের দশ-বারোজন ছেলেমেয়ে। গম্ভীর মুখের একজন পরিচারিকাও সেখানে থাকা আবশ্যক। পরিবারের অন্যান্য দাসীরাও আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে। এইরকম পরিবেশের মাঝখানেই মেহগনি কাঠের ডাইনিং টেবিল শোভা পায়।…
রেনের বক্তৃতার মাঝখানে জিল গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল, আমি আপনার স্যুটকেসটা ওপরে নিয়ে যাচ্ছি। সিঁড়ি দিয়ে উঠে পশ্চিম দিকের বড় ঘরটাই ঠিক করা হয়েছে আপনার জন্যে।
মলিও মাথা নেড়ে বলল : হ্যাঁ, তাই ভালো।
স্যুটকেসটা হাতে নিয়ে জিল সিঁড়ি বেয়ে পরে উঠে গেল। ততক্ষণে রেন আবার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন হল ছেড়ে। রেন বলল–আচ্ছা খাটের চারপাশে নিশ্চয় মশারি টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর মশারিটাও নিশ্চয় বাহারি ধরনের? মশারির মাথায় সুতো দিয়ে নিশ্চয় ফুলের নকশা করা।