লণ্ডনের ওই মেয়েটা মারা যাবার আগে তখন আমাকে চিনতেই পারল না। তখন তার মুখেও দেখা দিল ভয়ের ছাপ। বোকা বুড়ি মিসেস বয়েলের খুন হওয়াটা কম মজার নয়।
আনন্দ সহকারে ট্রেটার মাথা দোলান। তারপর শিস দিতে লাগল–তিনটে ইঁদুর অন্ধ…
ট্রেটার যেন কিছুটা হকচকিয়ে গেল। তার হাতের মুঠোর রিভলবারটা কিছুটা কেঁপে উঠল। ঠিক সেই মুহূর্তে কেউ যেন বলে উঠল-মিসেস ডেভিস, আপনি শুয়ে পড়ুন।
মলি কিছু না বলেই নরম কার্পেটের মধ্যে শুয়ে পড়ল, ইতিমধ্যে মেজর মেটকাফ ট্রেটারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ট্রেটারের রিভলবারটা দূরে ছিটকে পড়ল। আচমকা একটা গুলি গিয়ে লাগল দেওয়ালে টাঙানো একটা অয়েল পেন্টিংয়ের বুকে।
সমস্ত ড্রইংরুমে এখন বিশৃঙ্খলা পরিবেশ। জিল রিভলবারের আওয়াজ শুনতে পেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির হল। তার পেছনে মিঃ রেন ও মিঃ প্যারাভিসিনি। প্রত্যেকের চোখেমুখে একটা উৎকণ্ঠা ও ভয়।
মেজর মেটকাফ ছদ্মবেশী ট্রেটারের দুটো হাত ধরে পরিবেশটা সকলকে বুঝিয়ে দিলেন।
মিসেস ডেভিস, যখন পিয়ানো বাজানোয় মগ্ন ছিলেন, তখন আমি চুপি চুপি ভেতরে ঢুকে সোফার আড়ালে লুকিয়ে থাকি, প্রথম থেকেই আমি ওকে চোখে চোখে রেখেছিলাম। কেননা আমি জানতাম ও পুলিস অফিসার নয় আমিই পুলিস অফিসার ইনসপেক্টর ট্রানার মেটকাফের ছদ্মবেশে আমি এখানে এসেছি। কারণ স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড এখানে কোনো দায়িত্বজ্ঞান পুলিস অফিসারের উপস্থিতি যুক্তিযুক্ত মনে করে।
ভদ্রলোক একবার ট্রেটারের দিকে তাকালেন। তারপর আবার বললেন–তাহলে ট্রেটার এখানে আর কোনো গণ্ডগোল করার চেষ্টা করো না। ঠান্ডা হয়ে আমার সঙ্গে চলো, আমি কথা দিলাম, এখানে কেউ তোমার গায়ে হাত তুলবে না।… আমার কথাটা মাথায় ঢুকেছে তো?
ট্রেটারের মধ্যে দেখা গেল এক আমূল পরিবর্তন। কিছু আগের উগ্রতা ভাবটা তার মধ্যে এখন আর দেখা গেল না। শান্ত ছেলের মত এখন বাধ্য ও বিনয়ী, এই মুহূর্তে তার গলাটাও যেন মনে হল অল্পবয়সী ছেলের মত। বলল, জর্জ আমার ওপর রাগ করবে না তো?
মেটকাফ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল–না, না জর্জ কিছুতেই রাগ করবে না। তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই। জিলের পাশ দিয়ে যাবার সময় সে আস্তে বলল–একেবারে উন্মাদ। বদ্ধউন্মাদ।…সত্যিই হতভাগ্য মূক।
ট্রেটারকে সঙ্গে নিয়ে মেটকাফ বাইরে চলে গেল। মিঃ প্যারাভিসিনি দু পা এগিয়ে ক্রিস্টোফারের হাত ধরে বলল–চলুন– আমরাও চলে যাই।
বড় ড্রয়িংরুমের মধ্যে মলি ও জলি দুজনে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। পরে জিলের দুই বাহুর মধ্যে ধরা দিল মলি। তখন সে ভয়ে কাঁপছে।
জিলের গলায় একরাশ উৎকণ্ঠার সুরে বলল–তুমি কোনো আঘাত পাওনি তো মলি।
মলি বলল–না, না আমি ভালো আছি। কিন্তু আমার মধ্যে এমন কতগুলো উদ্ভব ধারণা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে…প্রথমে তো আমি ভেবেছিলাম… তুমি… নিশ্চয় ঐদিনে লণ্ডন গিয়েছিলে…।
জিল বলল–হ্যাঁ গিয়েছিলাম। আগামীকাল ছিল আমাদের বিবাহবার্ষিকী, তোমার জন্য একটা উপহার আনতে যাওয়াই ছিল আমার উদ্দেশ্য। ভেবেছিলাম তোমাকে একটা চমক লাগিয়ে দেবো। তাই গোড়ায় কিছু বলিনি।
মলি অবাক সুরে চেঁচিয়ে বলল–কি আশ্চর্য! সেদিন তো আমিও লণ্ডনে গিয়েছিলাম।
জিল অনুতাপের সুরে বলে–আমি তোমার উপর খুব বাজে ব্যবহার করেছি। কেন জানি না ওই আধপাগলা যুবকটিকে প্রথম দেখামাত্র একটা হিংসার ভাব জেগে উঠেছিল। অথচ তার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। হয়ত আমার তখন বিচারবুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। আমায় তুমি ক্ষমা করো মলি।
বন্ধ করা দরজাটা একটু ফাঁক করে প্যারাভিসিনি উঁকি দিলেন। তার হাবভাবে বেশ একটা খুশির আমেজ, সে বলল–এই পুনর্মিলনে বাধা দিতে বাধ্য হলাম বলে আমি দুঃখিত। সত্যি বলতে কি এমন দৃশ্যের তুলনা হয় না। কিন্তু হায়। আমার যাবার সময় এসে গেছে। আমি এখন আপনাদের কাছে বিদায় নিতে এসেছি। পুলিসের একটা জিপ এই বরফের পাহাড় ভেদ করে কোনোরকমে আমি এখানে এসে পৌঁছেছি। অনেক কষ্টে তাদের রাজী করিয়েছি আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য।
প্যারাভিসিনি মলির কাছে এসে কানে কানে বলল–তবে ম্যাডাম, অদূর ভবিষ্যতে আপনার নামে যে বাক্সটা পাঠাবো তার মধ্যে বিশেষ টোস্ট তৈরির মশলা সমস্ত মজুত থাকবে। তার সঙ্গে দু-চার জোড়া মোজা থাকবে। আশা করি অনুগত ভক্তের এই সামান্য উপহারটুকু গ্রহণ করতে আপনি অরাজী হবেন না।… আর হ্যাঁ আমার চেকটা হলঘরের পেপারওয়েটের নিচে চাপা দেওয়া আছে।
প্যারাভিসিনি মলির হাতের তালুতে মৃদু চুম্বন করে দ্রুত পায়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন।
মলি বিড় বিড় করে বলল–নাইলন। যকৃতের তেল,… মিঃ প্যারাভিসিনি কি তাহলে আসলে খ্রীস্টমাস বুড়ো সান্তাক্লজ নাকি?
কথাবার্তার ধরনধারণ দেখে মনে হয় কালোবাজারীদের কোনো বড় চাই–জিল পরিহাসছলে কথাটা বলল।
জিলের কথা শেষ হতে না হতেই ক্রিস্টোফার রেন আবার এল। তার চালচলনে একটা ব্যস্ততার ছাপ। সে বলল–আপনাদের কথায় মাথা গলাতে বাধ্য হচ্ছি। বেশ কিছুক্ষণ ধরে রান্নাঘরের দিক থেকে একটা পোড়া পোড়া গন্ধ ভেসে আসছে। মনে হয় এবিষয়ে আপনার একবার নজর দেওয়া উচিত।
মলির গলা দিয়ে একটা আর্তনাদের সুর বেরিয়ে এল, বলল–হ্যায় হায়…। এতকষ্ট করে মাংসের কোপ্তাগুলো করলাম মনে হয় সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল এতক্ষণে।