প্যারাভিসিনিই তাহলে রেনের ঘর থেকে শিস্ দিতে শুরু করেছেন। যুবক ক্রিস্টোফারের ভূমিকাটুকু বেশ ভালোই ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। আচমকা পাশের ঘর থেকে বেতার ঘোষিকার সুরেলা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। সার্জেন্ট ট্রেটারই নিশ্চয় রেডিওটা চালিয়ে দিয়েছেন।
ভদ্রলোক কি তাহলে মিসেস বয়েলের ভূমিকাই গ্রহণ করলেন।
কিন্তু কেন?
এই পরিকল্পনার পশ্চাতে আসল উদ্দেশ্যই বা কি?
গোপন ফাঁদটাই বা কোথায়।
ফাঁদ যে একটা পাতা আছে সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
মলি অন্তত মনে মনে নিশ্চিত।
একঝলক ঠান্ডা হাওয়া হঠাৎ তার পিঠে এসে লাগলো।
কেউ যেন নিঃশব্দে পেছনে দাঁড়িয়ে তুহিন শীতল হাত রাখলো ঘাড়ের ওপর। ভীষণ ভাবে চমকে উঠে ফিরে তাকালো মলি।
কেউ কোথাও নেই।
দরজাটা আগের মতোই বন্ধ। নিশ্চয় দরজাটা কেউ খুলে ছিলো। তা নাহলে ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শ পাবে কেন?
মনে মনে মলি ভীষণ সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো। যদি সত্যিই কেউ সকলের অলক্ষ্যে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
ব্যক্তিটি প্যারাভিসিনি হওয়াও বিচিত্র নয়।
তিনিই হয়তো এখন সহজাত সাবলীলভঙ্গিতে পেছন থেকে মলির ওপর ঝুঁকে পড়ে দশটা বাঁকানো শক্ত আঙুল দিয়ে…আপনি তাহলে সত্যিই ম্যাডাম আপনার মৃত্যুর সুর বাজিয়ে চলেছেন?
বাঃ…দৃশ্যটা বেশ মনোহর! … দূর, কি যে সব আবোল-তাবোল চিন্তা হচ্ছে মাথার মধ্যে।
সমস্তই অলীক অর্থহীন কল্পনা। বাস্তবের সঙ্গে তার কোনো যোগযোগ নেই।
তাছাড়া ভদ্রলোক তো এখনো আগের মতোই মৃদু সুরে শিস্ দিচ্ছেন। দোতলায় রেনের শোবার ঘর থেকেই ভেসে আসছে শব্দটা।
হঠাৎ একটা কথা মনে আসতেই মলি পিয়ানোর ওপর থেকে হাত গুটিয়ে নিলো। প্যারাভিসিনির বাজনা কিন্তু কেউ শুনতে পায়নি।
আসল রহস্যটা কি সেইখানে?
হয়তো আদপেই ভদ্রলোক তখন পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন না।
তার পরিবর্তে লাইব্রেরি ঘরে মিসেস বয়েলকে গলা টিপে হত্যা করবার কাজে ব্যস্ত ছিলেন।
ট্রেটার যখন মলিকে প্যারাভিসিনির ভূমিকা নিতে বললেন, তখন ভদ্রলোক খুব বিরক্ত বোধ করছিলেন।
তার চোখেমুখে একটা বিমূঢ় বিভ্রান্ত ভাব ফুটে উঠেছিলো।
এবং তিনি যে খুবই মৃদু সুরে পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন সে কথাটাও দৃষ্টান্ত সহযোগে বুঝিয়ে দিলেন মলিকে।
হয়তো এই বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য যে তাঁর সঙ্গীতের সুরটা এতই নিম্ন গ্রামে বাঁধা ছিলো যে বাইরে থেকে সেটা শুনতে পাওয়া যায় না।
কিন্তু এখন এই নাটকের পুনরাভিনয়ের সময় যদি সুরটা কারো কানে যায় তবে প্রকৃত পক্ষে ট্রেটারের উদ্দেশ্যই সফল হবে।
আসল অপরাধীও ধরা পড়বে হাতে নাতে। ড্রয়িংরুমের ভেজানো দরজা আস্তে আস্তে খুলে গেল। মলি ভেবেছিল যে আগন্তুক বোধহয় প্যারাভিসিনি, সেই ভেবে ভয় পেয়ে চিৎকার করতে যাচ্ছিল কিন্তু ট্রেটারকে দেখে সে মনোবল ফিরে পেল। কোনরকমে বেরিয়ে আসা আর্তনাদটাকে সে চেপে রইল। তার বাজনাও সবেমাত্র শেষ হয়েছে।
ট্রেটার উচ্ছ্বাসের সুরে বলল–অসংখ্য ধন্যবাদ মিসেস ডেভিস। তার চোখে মুখে একটা চঞ্চলতার কুটিল ছায়া খেলে গেল। তার গতিভঙ্গিতে দেখা গেল এক বলিষ্ঠের ছাপ।
মলি এবার পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে সার্জেন্টের দিকে তাকিয়ে বলল–আপনার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে কি? আপনি যাকে চাইছিলেন তাকে খুঁজে পেয়েছেন?
আনন্দের সঙ্গে ট্রেটার মাথা দুলিয়ে বলল–হ্যাঁ নিশ্চয় যাকে চেয়েছিলাম তাকেই পেয়েছি। মলি প্রশ্ন করে, তাহলে প্রকৃত অপরাধী কে? তার নাম কি।
ট্রেটার বলল–মিসেস ডেভিস, আপনি কি সিত্যই জানেন না? কিন্তু ব্যাপারটা কিন্তু তেমন কিছু নয়। আপনি খুব বোকা বলেই সে লোকটিকে আপনি খুঁজে পাননি। শুধু আপনি কেন –আপনারা সকলেই বোকা। আর আপনাদের এই বোকামি আমাকে তৃতীয় শিকারের মুখোমুখি দাঁড়াবার সুযোগ করে দিয়েছে। সত্যিই ম্যাডাম, আপনার এখন সাংঘাতিক বিপদ।
মলি বলল–আমি?… আপনি কি বলছেন আমি তা কিছু বুঝতে পারছি না।
ট্রেটার বলল–আমার বক্তব্য খুব একটা জটিল নয় মিসেস ডেভিস, মিসেস বয়েলের মত আপনিও সত্যটাকে লুকিয়েছেন। সবকিছু স্বীকার করেননি।
মলি বলল–তার মানে? আপনি কি বলতে চাইছেন?
হা আপনিই।… আমি যখন লঙরিজ ফার্মের মামলাটার কথা বললাম, তখন এই সমস্ত ঘটনা আপনি জানতেন। এই মামলা সংক্রান্ত প্রতিটি ঘটনাই আপনার জানা। তাই আমার কাছ থেকে ঘটনাটা শোনা মাত্র আপনি অস্থির হয়ে উঠলেন। মিসেস বয়েল যে ওই সময় পুনর্বাসন দপ্তরের একজন অফিসার ছিলেন তা প্রথম আপনিই বললেন, আপনারা দুজনেই এ অঞ্চলের অধিবাসী। সেই জন্য যখন আমি মনে মনে হিসেব করে দেখলাম তৃতীয় শিকার হওয়ার সম্ভাবনা কার সব থেকে বেশি, তখন সবার আগে আপনার মুখটাই আমার মনে আসে। লক্ষ্য করে দেখলাম ওই মামলার ব্যাপারে আপনি অনেক কিছুই জানেন। সাধারণ দৃষ্টিতে পুলিশের যতই নিরীহ প্রকৃতির মনে হোক না কেন, তাদের চোখ কান সবসময় ভোলা থাকে।
মলি অবাক চোখে ট্রেটারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তারপর ক্লান্তস্বরে বলল– আমার মানসিক অবস্থাটা আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। ওই দুঃস্বপ্নের স্মৃতিটা আমি আমার মন থেকে মুছে ফেলতে চাই।
ট্রেটার ঠান্ডা গলায় বলল–হ্যাঁ সেটা আমি বুঝতে পারছি। আপনার কুমারী জীবনের পদবীতো ওয়েনরাইন? ঠিক তো?
মলি ঘাড় নেড়ে বলল।