মিঃ রেন সত্যিই কি তাই?
জিল আস্তে আস্তে মাথা দুলিয়ে বলল–হ্যাঁ, নিশ্চয়, আপনার বক্তব্যের মধ্যে যথেষ্ট যুক্তি আছে বলে আমি মনে করি সার্জেন্ট। আমরা এব্যাপারে সকলেই আপনাকে যতটা পারি সাহায্য করব। আমরা ওই সময় কে কি কাজ করছিলাম আমাদের সেই কাজই করতে হবে, তাই তো?
ট্রেটার বলল–হ্যাঁ আপনি ঠিক বলেছেন। আমি আরেকবার দেখতে চাই।
ট্রেটারের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মেজর মেটকাফ। ট্রেটার সেদিকে গ্রাহ্যই করল না। প্যারাভিসিনিকে লক্ষ্য করে বললেন, মিঃ প্যারাভিসিনি আপনি তো পিয়ানোতে একটা গানের সুর তুলছিলেন তাই তো? আপনি তখন ঠিক কি করছিলেন দয়া করে একবার দেখাবেন?
প্যারাভিসিনি দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গিয়ে পিয়ানোর সামনে টুলের ওপর বসলেন। তিনি মুচকি হেসে সকলের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন- এই প্রাণহীন পিয়ানোর ভেতর থেকে এখুনি মৃত্যুর সুর ভেসে আসবে। সকলে মন দিয়ে শুনুন। সেই বিখ্যাত সুর তিনটে ইঁদুর অন্ধ।
যথারীতি পিয়ানোর সাদা কালো রীডের ওপর হাত দিলেন তিনি।
ভদ্রলোক বেশ উপভোগ করছেন ব্যাপারটা মলির তাই মনে হল। সত্যিই তিনি বেশ সয়ে সয়ে উপভোগ করছেন ব্যাপারটা।
বড় ড্রয়িংরুমের মধ্যে এই সুরটা যেন একটা মাদকতা নিয়ে এল সকলের বুকের ওপর দিয়ে যেন একটা শিহরণ লেগে যাচ্ছে।
সার্জেন ট্রেটার তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন– ধন্যবাদ, মিঃ প্যারাভিসিনি, ঠিক এটাই জানতে চাইছিলাম। আগের বারেও আপনি এই একইভাবে বাজাচ্ছিলেন?
সে উত্তর দিল, হ্যাঁ সার্জেন্ট। একেবারে এইরকম। এবং মাত্র তিনবার আমি এই লাইনটা করেছিলাম।
মলির দিকে তাকালেন ট্রেটার, বললেন মিসেস ডেভিস আপনি পিয়ানো বাজাতে পারেন?
মুখে কিছু না বলে শুধু সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল মলি, মিঃ প্যারাভিসিনি যেভাবে দেখালেন, সেভাবে নিশ্চয় সুরটা ফোঁটাতে পারবেন?
মলি বলল–খুব ভালোভাবেই পারব?
ট্রেটার বললেন, তাহলে আপনি এই টুলের ওপর গিয়ে বসুন এবং আমার বলামাত্র আপনি বাজানোর জন্য প্রস্তুত থাকবেন।
মলির মুখের পর যেন একটা বিভ্রান্তির ছায়া ফুটে উঠল। তারপর পায়ে পায়ে বিপরীত দিকে পিয়ানোর দিকে এগিয়ে গেল।
প্যারাভিসিনি একটি বিরক্তি ভঙ্গিতে টুল ছেড়ে দাঁড়ালেন। তার গলায় শোনা গেল মৃদু প্রতিবাদের সুর– কিন্তু সার্জেন্ট আমার ধারণা ছিল– আমরা সবাই যে যার নিজের ভূমিকাটাই দুবার পালন করব। আমি তো সেইসময় পিয়ানোই বাজাচ্ছিলাম।
ট্রেটার বলল হ্যাঁ আগের কাজ একই থাকবে তার কোথাও কোনো বিচ্যুতি হবে না। তবে একই ব্যক্তির দ্বারা যে তা পালিত হবে তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
জিল আবার বিড়বিড় করে বলল এর পেছনে যে কি উদ্দেশ্য আছে তা তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
এর পেছনে সুনির্দিষ্ট একটা কারণ ঠিক আছে মিঃ ডেভিস। প্রত্যেকেরই কথাটুকু যাচাই করার জন্য এই একটাই পথ আমি বলতে চাই। তাহলে আমি আপনাদের ভূমিকাটুকু জানিয়ে দিচ্ছি। মিসেস ডেভিস এখানে এই পিয়ানোর কাছে আপনি অপেক্ষা করুন। মিঃ রেন, আপনি রান্নাঘরের দিকে যান দয়া করে, মিসেস ডেভিসের রান্নাবান্নার দিকে একটু নজর রাখবেন। আপনাকে মিঃ রেনের শোবার ঘরে যেতে হবে, মিঃ প্যারাভিসিনি। সেখান থেকে আপনি ঐরকম শিস্ দিতে থাকুন। ওই সুরটাই ফুটিয়ে তুলবেন। সুরটা তো খুব প্রিয় আপনার। মেজর মেটকাফ, আপনি মিঃ ডেভিসের শোবার ঘরে টেলিফোনের লাইনটার দিকে লক্ষ্য রাখবেন আর মিঃ ডেভিস সিঁড়ির দিকে কাঠের আলমারির পাশ দিয়ে অন্ধকার গুপ্তকক্ষের দিকে এগিয়ে যান।
কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বললেন না, তারপর চারজনই কোন কথা না বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। ট্রেটারও তাদের পেছন পেছন গেল।
ট্রেটার বলল–মিসেস ডেভিস আপনি এক থেকে পঞ্চাশ গুনুন। গোনা শেষ হলেই পিয়ানোয় হাত দেবেন।
ট্রেটার ফের সকলের পেছন পেছন চলল। দরজাটা জোরে বন্ধ হবার আগে প্যারাভিসিনির হতচকিত কণ্ঠস্বর মলির কানে ভেসে এলো।
পুলিস যে কখনও আবার এই ধরনের ছেলেখেলায় মেতে ওঠে, সে কথা জন্মে কোনোদিন শুনিনি।
আটচল্লিশ…উনপঞ্চাশ…পঞ্চাশ… গোনা শেষ করে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো মলি।
তারপর বাধিত ভঙ্গিতেই সাদা কালো রীডগুলোর ওপর ঝুঁকে পড়লো।
তার নরম আঙুলের মৃদুস্পর্শে যেন প্রাণ ফিরে পেলো পিয়ানোটা।
প্রশস্ত ড্রয়িংরুমের মধ্যে এমন একটা ক্রুর নিষ্ঠুর ছন্দই শুধু বুকে হেঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
চার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সুরটা।
তিনটে ইঁদুর অন্ধ।
জানলা কপাট বন্ধ…
মলির মনে হলো তার হৃৎস্পন্দনও বুঝি দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে ক্রমশ শিরায় শিরায় অস্তির এক উত্তেজনা। শরীরের সমস্ত রক্তকণিকাও যেন নাচতে শুরু করেছে তালে তালে। দেখা যাচ্ছে প্যারাভিসিনি যা বলেছিলেন।
মিথ্যা নয়।
বরঞ্চ তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। এই ছড়াটার মধ্যে এক ধরনের ক্রুর নিষ্ঠুরতা আছে। এবং মনের ওপরও এর প্রভাব খুবই দূর প্রসারী।
শিশুবেলায় এই ছড়া শুনে কি অবোধ নিষ্ঠুরতায় মেতে উঠতো মনটা! পরিপূর্ণভাবে সাবালক হবার পরেও তার প্রভাবটুকু যেন কাটিয়ে ওঠা যায় না।
দোতলায় কোনো শোবার ঘর থেকে এই একই সুরে শিস্ দিচ্ছে কেউ। তবে শব্দটা খুবই মৃদু এবং অস্পষ্ট।
কান খাড়া করে না শুনলে সবটা ঠিক উপলব্ধি করা যায় না।