মৃদু শব্দে কেশে উঠলেন প্যারাভিসিনি।
পরিবেশটা সত্যিই বেশ অস্বস্তিকর! বিব্রত কণ্ঠে মন্তব্য করলেন তিনি।
আমি আশা করি, তোমাদের এই মনোমালিন্যটাও তেমন গভীর নয়।
যুবক যুবতীদের দাম্পত্য কলহে এমন অনেক অবাঞ্ছিত প্রসঙ্গেরই অবতারণা ঘটে থাকে, যাকে হালকা ভাবে গ্রহণ করা উচিত।
জিল তীব্র স্বরে বলে উঠল–দাম্পত্যকলহ? খুব ভালো বলেছেন কথাটা।
প্যারাভিসিনি মাথা নেড়ে বললেন–হ্যাঁ নিশ্চয়, তোমাদের তরুণ মনের ভেতরে যে আলোড়ন চলছে তা আমি বুঝতে পারছি। কারণ একসময় তোমাদের এই বয়সটা আমি পার হয়ে এসেছি। এবং আমার স্ত্রীও খুব মুখরা ছিল। কিন্তু আমি যা এখন বলতে এসেছি তা হল এই যে, ইনসপেক্টর ট্রেটার আমাদের সকলকে ড্রইংরুমে যেতে বলছেন। কথাবার্তা শুনে মনে হল ভদ্রলোকের মাথায় নতুন কোনো পরিকল্পনা এসেছে। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন–পুলিস কোনো সূত্র পেয়েছে তা প্রায়ই শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু পুলিসের মাথায় কোনো পরিকল্পনা এসেছে একথা কেউ শুনেছে বলে তো আমার বিশ্বাস হয় না। আমাদের এই পুলিস অফিসার সার্জেন্ট ট্রেটার খুবই জেদী এবং পরিশ্রমী এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তেমন একটা তার বুদ্ধি আছে বলে তো মনে হয় না।
মলি বলল–জিল, তুমিই হয় যাও আমার এখনও রান্না বাকি আছে। সম্ভবতঃ সার্জেন্ট ট্রেটার তার কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন।
প্যারাভিসিনি বলল,–রান্নার কথাই যখন উঠলো আপনি কি কখনও রুটির টুকরোর উপর মুরগীর মেটে ছড়িয়ে তার ওপর যকৃতের তেল দিয়ে ভাজা শুয়োরের মাংস আর রহিসরষের মোটা প্রলেপ দিয়ে কখনও টোস্ট তৈরি করেছেন? ওঃ, সে কি অপূর্ব খেতে।
জিল রুক্ষুকণ্ঠে জবাব দিল-যকৃতের তেল এই বাজারে খুব একটা পাওয়া যায় না। আসুন মিঃ প্যারাভিসিন।
আমি কি এখান থেকে আপনাকে সাহায্য করবো কোনোভাবে ম্যাডাম?
জিলের কণ্ঠে বাজল অন্য সুর– তার কোনো প্রয়োজন হবে না। আপনি আমার সঙ্গে ড্রয়িংরুমেই চলুন। প্যারাভিসিনি মুচকি হাসলেন। বললেন– আপনার স্বামী ভয় পাচ্ছেন আমাকে। যদিও এটাই স্বাভাবিক। তিনি আমাকে আপনার সঙ্গে একা রাখতে চান না। সম্ভবতঃ আমার এই অদ্ভুত চেহারাটাই দায়ী এজন্য। তবে তিনি যে অসম্মান করছেন আমায়, তা কিন্তু নয়। এবং তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি যেতে চাই না। ভদ্রলোক কথাটা বলে আড়ম্বর সহকারে বিদায় নিল।
মলি অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলে উঠল–মিঃ প্যারাভিসিনি নিশ্চয় আপনি….
প্যারাভিসিনি ডান ও বাঁদিকে মাথা ঘুরিয়ে জিলকে উদ্দেশ্য করে বললে– সত্যিই আপনার মাথায় বেশ বুদ্ধি ধরেন মিঃ ডেভিস। কোনোরকম সুযোগ নেওয়ার পক্ষপাতি আমি নই। আমি কি আপনার ও ট্রেটারের কাছে নির্দোষিতার প্রমাণ দাখিল করব। আমি যে একজন খুনে উন্মাদ নই, আপনারা কি সেকথা বিশ্বাস করবেন? কিন্তু তা সম্ভব হবে কিভাবে? নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা খুবই কষ্টসাধ্য…।
ভদ্রলোক কথা থামিয়ে আস্তে আস্তে শিস্ দিতে শুরু করল।
মলি অস্বস্তি সুরে বলল, দোহাই আপনার। দয়া করে আর ওই সুরটা বাজাবেন না।
তিনটে ইঁদুর অন্ধ–ছড়ার এইগুলো কথাই তো তাই না? এখন আমি এর মানেটা বুঝতে পারি। খুবই ঘৃণ্য নিষ্ঠুর লেখা। নার্সারির পদ্য হিসাবেও এর কোনো সাহিত্যিকগত মূল্য নেই। গ্রাম্য কবির নিষ্ঠুর মানসিকতাই প্রতিটি লাইনে ফুটে উঠেছে। কিন্তু বাচ্চারা অনেক সময় এই নিষ্ঠুরতা পছন্দ করে। সেইজন্য তারা মনে রাখে ছড়াটা। তিনটে অসহায় ইঁদুরের শোচনীয় এই অবস্থাই তাদের মনে আনন্দের খোরাক জোগায়। সেই শেষ দৃশ্যটার দৃশ্য খুবই করুণ, চাষীর বউ একটা ধারালো কঁচি দিয়ে ইঁদুরের লেজগুলো কেটে দিচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণায় তিনটে অন্ধ ইঁদুর ছটফট করছে। ব্যাপারটা দেখতে খুব একটা ভালো লাগে না। কিন্তু বাচ্চারা এতেই আনন্দ পায়।
মলি ক্ষোভ ও হতাশার সুরে বলে উঠল–মিঃ প্যারাভিসিনি আমার একান্ত অনুরোধ, এ ধরনের আলোচনা আপাততঃ এখন আপনি বন্ধ করুন। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি খুবই নিষ্ঠুর আর পৈশাচিক। মলির মুখটা আস্তে আস্তে রাগে রাঙ্গা হয়ে উঠল। তাকে একজন রুগী ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না। গলার সুরটা যেন আজ অন্য সুরে বাজছে। সে আবার বলতে শুরু করল–আপনি তো সারাক্ষণ শুধু হেসেই বেড়াচ্ছেন। আপনাকে মনে হচ্ছে দেখে আপনি যেন একটা বেড়ালসর্বদা আমাদের মত ইঁদুরের সঙ্গে আপনি খেলা করছেন।
কথা থামিয়ে জোরে জোরে হাসতে থাকে মলি।
জিল বলল–মলি শান্ত হও। চলো আমরা না হয় ড্রয়িংরুমে একসঙ্গে যাই। নিশ্চয় ট্রেটার খুব বিরক্ত হয়ে উঠেছেন। রান্নাবান্না পরে করলেও চলবে। খুনের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলাই এখন জরুরী।
প্যারাভিসিনি যেতে যেতে মন্তব্য করলেন–আমি আপনাদের সাথে যেতে না পারার জন্য দুঃখিত। ফাঁসির আসামীরা তাদের প্রাতঃরাশটা খাওয়ার সময় উপভোগ করে!
রেনের সঙ্গে দেখা হল বড় হল ঘরটায়। জিল কটাক্ষ দৃষ্টিতে একবার তাকে দেখল। কিন্তু মলি তার দিকে একবারের জন্যও তাকালো না। দৃষ্টি সামনে রেখে সে সোজা এগিয়ে গেল। দলটা যেন মৌন শবযাত্রার লাইনের মত হেঁটে চলল।
সার্জেন্ট ট্রেটার ও মেজর মেটকাফ ড্রয়িংরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। মেটকাফের মুখে একটা চাপা রাগের ছাপ ফুটে উঠেছে। ট্রেটার কিন্তু বেশ প্রাণচঞ্চল।